বছরে ১০০ কোটি টাকা মুনাফা হবে এমন যুক্তিতে কেনা হয়েছিল ট্রেনগুলো। তবে সে মুনাফা কখনোই দেখা যায়নি। বরং শুরু থেকেই রেলের লোকসানের বোঝা বাড়িয়েছে ট্রেনগুলো। আবার ২০ বছর আয়ুষ্কাল ধরা হলেও এক বছরও ঠিকমতো চলেনি ট্রেনগুলো। এতে নিয়মিত সেবাই পাওয়া যায়নি ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট তথা ডেমু নামের এ ট্রেনগুলো থেকে।
উল্টো শুরু থেকেই নিয়মিত বিকল হতে থাকে সামনে-পেছনে ইঞ্জিনবিশিষ্ট এ ডেমুগুলো। এতে ২০ সেটের ১৭ সেট ট্রেনই বর্তমানে বিকল পড়ে আছে রেলের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে। এ ছাড়া চীন থেকে কেনা নিম্ন মানের এ ট্রেনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে সীমিত আকারে মেরামত করা হলেও নানা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়।
তথ্যমতে, সেবার মান বাড়াতে ২০১০ সালে ২০ সেট ডেমু কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৬৫৪ কোটি টাকা। তবে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে সে সময় এত বড় প্রকল্প অনুমোদনে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ডেমু রেলের জন্য লাভজনক প্রকল্প এমন যুক্তি তুলে ধরা হয় তখন। ২০ সেট ডেমু থেকে বছরে শতকোটি টাকা লাভ হবে এমন হিসাবও দেখানো হয়।
তাতে বলা হয়, প্রতি সেট ডেমু থেকে বছরে রেলের আয় হবে সাড়ে ৪ কোটি টাকা। তবে যাত্রী ক্রমান্বয়ে বাড়ায় তা ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় পৌঁছবে। এতে ২০ সেট ডেমু থেকে বছরে প্রত্যক্ষ আয় হবে ৯৯ কোটি টাকা। আর ট্রেনগুলো উন্নতমানের হওয়ায় ভ্রমণকাল কমবে। পাশাপাশি সেবার মান বাড়বে। ফলে বছরে অতিরিক্ত ৫ কোটি টাকা আয় হবে। অর্থাৎ ২০ সেট ডেমু থেকে বছরে রেলের আয় হবে ১০৪ কোটি টাকা। আর ২০ সেট ডেমুর সাধারণ পরিচালন ব্যয় হবে বছরে এক কোটি টাকা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে দুই কোটি এবং খুচরা যন্ত্রপাতি কেনা ও জ্বালানি বাবদ দেড় কোটি টাকা। এতে ২০ সেট ডেমু পরিচালনায় ব্যয় হবে বছরে সাড়ে চার কোটি টাকা। এ ছাড়া ডেমু উন্নতমানের হওয়ায় দুর্ঘটনা কমবে। ফলে এ খাতে বছরে ৫০ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে।
এসব বিষয় উল্লেখ করে ২০ সেট ডেমুর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হয়। ২০১১ সালে একনেক প্রকল্পটি অনুমোদন করে। আর কেনার পর ডেমুগুলো দেশে আসে ২০১৩ সালে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরে। সে বছরের ২৪ এপ্রিল ডেমু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। তবে ডেমু পরিচালনা করতে গিয়ে ডিপিপির হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উদ্বোধনের প্রথম বছরে ডেমু পরিচালনায় জ্বালানি ও মেকানিক্যাল খরচ ছিল প্রায় ৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর বাইরে ট্রেন চালকসহ অন্যান্য লোকবলের মাসিক বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ হয় ৮৪ লাখ টাকা। আর মেরামত ব্যয় হয় দুই কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এক বছরে ডেমু পরিচালনায় রেলের ব্যয় হয় ৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আয় হয় মাত্র দুই কোটি টাকা। ফলে এক বছরে ট্রেনগুলো থেকে রেলের লোকসান হয় ৩৬ কোটি টাকার বেশি। এভাবেই চালুর পর থেকেই প্রতি বছর রেলের লোকসানের বোঝাই ভারী করছে ডেমু।
এদিকে ডেমুর আয়ুষ্কাল ২০ বছর ধরা হলেও, দ্রুতই সেগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ডেমু পরিত্যক্ত বলা যাবে না। যদিও স্বল্প দূরত্বের এই ট্রেনগুলো ১০০-১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত চালানো হয়েছে, সেটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। অর্থাৎ যেভাবে এগুলো চালানো উচিত ছিল, সেভাবে চালানো হয়নি। এখন এগুলো মেরামতের প্রক্রিয়ায় আছে। কয়েকটি বড় ধরনের আর কয়েকটি ছোট ধরনের মেরামতের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
এদিকে ডেমু মেরামতেও নানা ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন রেলের কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিয়ে গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এসব বিষয়ে প্রমাণসহ দুদকে লিখিত অভিযোগ জমা দেন।
প্রতিবেদনে ডেমু মেরামতে তিন ধরনের জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ডেমুর ইঞ্জিন মেরামতে মূল কোম্পানিকে বাদ দিয়ে স্থানীয় এক কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে। আবার ইঞ্জিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে অন্য কোম্পানি থেকে যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে। এ ছাড়া ইঞ্জিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহায়তা বা ম্যানুয়ালও নেয়া হয়নি।
রেলের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) এর মূল পরিকল্পনাকারী। তারা নিয়মনীতি ভঙ্গ করে স্থানীয় এক কোম্পানিকে এই কাজ দেয়। অথচ তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ নেই, কোনো ওয়ার্কশপ নেই। ওভারহোলিং করার কোনো যন্ত্রাংশও নেই। এ ছাড়া ইঞ্জিন নির্মাতা জার্মানির কোম্পানি এমএএনের থেকে ওভারহোলিংয়ের জন্য কোনো খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হয়নি, কোনো কারিগরি সহায়তা নেয়া হয়নি, ইঞ্জিন ওভারহোলিংয়ের কোনো ম্যানুয়ালও নেয়া হয়নি।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, রেলওয়ের মহাপরিচালক বিভাগীয় টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লোকোমোটিভ ডিএমই লোকো ঢাকা ও চট্টগ্রাম, ডব্লিউএম ডিজেল ঢাকা ও চট্টগ্রাম যৌথভাবে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ইঞ্জিনপ্রতি ৫৫ লাখ টাকা করে ওভারহোলিং বিল পরিশোধ করেছে। মহাপরিচালক নিজস্ব ক্ষমতার কৌশলে এই অর্ডার দেয়। এভাবে ১৫ ডেমুতে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা ইঞ্জিন ওভারহোলিংয়ের নামে লোপাট করা হয়। এ অর্থ মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস), বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, লোকোমোটিভ ডিএমই, লোকো ঢাকা, লোকো চট্টগ্রাম, ডব্লিউএম ডিজেল ঢাকা ও ডব্লিউএম ডিজেল চট্টগ্রাম ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগটি ছিল, ডেমুর জন্য বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহে মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাংশান ভেহিকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তবে ডেমুর খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য ৩৮টি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করেছে রেলওয়ে। আর এসব যন্ত্রাংশ কেনায় কোনো ধরনের উš§ুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে না। সীমিত দরপত্রের (এলটিএম) মাধ্যমে এসব কোম্পানি থেকেই ডেমুর যন্ত্রাংশ কেনা হবে। আবার ডেমুর মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাংশান ভেহিকলকে লিস্টেড না করায় বিভিন্ন যন্ত্রাংশের সঠিক দাম জানা যাচ্ছে না। এতে বেশি দামে কেনা হচ্ছে নিন্মমানের যন্ত্রাংশ।
তৃতীয় অভিযোগটি হলো, ডেমুর খুচরা যন্ত্রাংশ একেবারে সংগ্রহ না করে ছোট ছোট লটে কেনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের একটি দরপত্রের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ডেমুর জন্য ১২৭ লাইন আইটেম কেনার কথা ছিল। তবে তা একেবারে না কিনে এলটিএমের মাধ্যমে ৫-৬টি ভাগে কেনা হয়, যাতে সিসিএস নিজেই তা অনুমোদন করতে পারে। কারণ দরপত্রের মূল্য বেশি হলে তা অনুমোদনের ক্ষমতা সিসিএসের নেই। সে ক্ষেত্রে দরপত্র অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাতে হতো।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান ও বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেননি।
সূত্র:শেয়ার বিজ, ৬ জানুয়ারি ২০২২