৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনায় ২০১১ সালে প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। তবে এক দশকেও সেগুলো কেনা হয়নি। ২০১৮ সালে ইঞ্জিনগুলো কেনায় দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে চুক্তি হলেও তা বাতিলের পথে। এর মধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা গচ্চা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই ৭০টির পরিবর্তে ৩০টি ইঞ্জিন কিনতে চাচ্ছে রেলওয়ে।
ইঞ্জিনগুলো কেনায় ঋণ দিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে রেলের দুই প্রকল্পে বেঁচে যাওয়া ১১ কোটি ১০ লাখ ডলার ৩০টি ইঞ্জিন কেনায় ঋণ হিসেবে চাওয়া হয়। তবে তাতে সম্মত হয়নি এডিবি। এ মুহূর্তে রোলিং স্টক (ইঞ্জিন-কোচ) কেনায় কোনো ঋণ দিতে আগ্রহী নয় সংস্থাটি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত জানায় এডিবি।
সূত্র জানায়, ৭০ ইঞ্জিন কেনার প্রকল্পটি খুবই ধীরগতির। ১০ বছরে অগ্রগতি মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। তাই প্রকল্পটির অগ্রগতি পর্যালোচনায় গত মাসে বৈঠক আহ্বান করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগ। প্রকল্পটি ২০১১ সালের আগস্টে অনুমোদন করা হয়। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। তবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। সে সময় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হলেও পরে তা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। তবে ১০ বছরে প্রকল্পটির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ও ২০১৩ সালের ৪ জুলাই দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হলেও পরে তা বাতিল হয়। ২০১৪ সালে ৩য় দফা দরপত্র আহ্বান করা হলে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহের কাজ পায় হুন্দাই রোটেম। কোম্পানিটির সঙ্গে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর চুক্তি সই হয়। ১৮ থেকে ৬০ মাসের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহের কথা ছিল।
এদিকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ইঞ্জিনগুলো কেনায় ঋণ দেয়ার প্রস্তাব দেয় দুইটি প্রতিষ্ঠান। দরপত্রের সঙ্গে প্রাপ্ত ঋণপ্রস্তাবটি নিয়ে দরকষাকষি ও চুক্তি সইয়ের ব্যবস্থা গ্রহণে তা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হয় ২০১৮ সালের ৭ জুন। দরকষাকষির একপর্যায়ে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি ও আগস্টে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভায় প্রস্তাবটি নিয়ে দুই দফা আলোচনা হয়। পরে বিভিন্ন দপ্তরের মতামতের ভিত্তিতে গত বছর ৪ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় ইআরডি।
এতে বলা হয়েছে, ‘কোরিয়ান কোম্পানি কর্তৃক প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকার কর্তৃক এতো উচ্চ হার সুদে অনমনীয় গ্রহণের পরিবর্তে কোরিয়ান সরকারের নমনীয় উৎসের বা অন্য কোনো উৎসের নমনীয় প্রকৃতির ঋণ সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয় হবে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ নভেম্বর হুন্দাই রোটেমকে চিঠি দিয়ে সহজ শর্তের ঋণ সংস্থানের প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে সে প্রস্তাবে অনাগ্রহ প্রকাশ করে হুন্দাই। এর পরিবর্তে চুক্তি বাতিল ও চুক্তির সময় জমা দেয়া এক লাখ ১৫ হাজার ডলারের ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরতের অনুরোধ করে কোম্পানিটি। এছাড়া বিদ্যমান চুক্তির আওতায় ইঞ্জিনগুলো কিনতে হলে চুক্তিমূল্য ১৬ শতাংশ বৃদ্ধির শর্ত দেয় হুন্দাই। যদিও বিদ্যমান চুক্তিতে তার কোনো সুযোগ নেই বলে মতামত দেয় রেলওয়ে।
পরবর্তীতে প্রকল্পটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পিআইসি সভা আহ্বান করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ইঞ্জিনগুলো কেনায় হুন্দাইয়ের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল ও ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেয়ার বিষয়ে আইএমইডি ও সিপিটিইউয়ের (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট) মতামত নেয়া হবে। এ বিষয়ে দুই সংস্থাকে চিঠি দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আইএমইডি বৈঠক আহ্বান করে। সেখানে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী প্রস্তাব করেন, মিটারগেজ ইঞ্জিন বেশকিছু কেনার ফলে বর্তমানে প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেয়েছে। তবে এরই মধ্যে প্রকল্পের পাঁচ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। তাই ৭০টির পরিবর্তে ৩০টি ইঞ্জিন কেনার প্রস্তাব করেন তিনি। এজন্য তহবিল সংগ্রহের বিষয়ে জোর দেন তিনি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এডিবিকে ৩০টি ইঞ্জিন কেনায় ঋণ সরবরাহের প্রস্তাব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে বেঁচে যাওয়া পাঁচ কোটি ডলার ও রেলের রোলিং স্টক উন্নয়ন প্রকল্পের বেঁচে যাওয়া ছয় কোটি ১০ লাখ ডলার চাওয়া হয়। মোট ১১ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব এডিবিকে দেয়া হলেও তাতে সরাসরি অসম্মতি জানায় সংস্থাটি। এতে ইঞ্জিনগুলো কেনায় বিপাকে পড়েছে রেলওয়ে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময় বেতন-ভাতা, গাড়ি কেনা ও জ্বালানি ব্যয়, দরপত্র আহ্বান ও প্রক্রিয়াকরণ সব মিলিয়ে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন প্রকল্পটি বন্ধ করে দিলে ওই টাকাটা গচ্চা যাবে। আর ৭০টি ইঞ্জিন এখন আর প্রয়োজনও নেই। তাই ৩০টি ইঞ্জিন কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ঋণ পাওয়া গেলে দ্রুত প্রকল্পটি সংশোধনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, যদি একান্তই ঋণ পাওয়া না যায় তাহলে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ শুধু জিওবি অর্থ দিয়ে ১৫টি ইঞ্জিন কেনার চেষ্টা করা হবে। তবে তার আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দরকার হবে। তাই প্রকল্পটির শেষ পরিণতি নিয়ে এখনই মতামত দেয়া যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, ৭০টি ইঞ্জিন কেনায় জিওবির পরিমাণ ধরা আছে প্রায় ৬১৫ কোটি টাকা। এ অর্থে ১৫টি ইঞ্জিন কেনা যেতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।