রেলের তথ্য হস্তান্তরে গড়িমসির খেসারত- জনদুর্ভোগ
টিকেট কাটতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়ছেন মানুষ এমন সংবাদ শিরোনামই চোখে পড়ছে এখন। কিন্তু এর পেছনের গল্পের সন্ধানে গিয়ে জানা যায় হালনাগাদ তথ্য হস্তান্তরে গড়িমসির কারণেই মূলত দুর্ভোগে পড়ছেন দেশের মানুষ। তথ্য হস্তান্তরে আগের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা থাকা সত্যেও গত ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় একযোগে ৭৭টি রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টার থেকে কম্পিউটার প্রদত্ত নতুন টিকেট বিক্রি শুরুর মধ্য দিয়ে নতুন সূচনা করেছে টিকেটিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সহজ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫ মার্চ ৭৭টি রেলওয়ে স্টেশনে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত টিকেট বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার, ২৬ মার্চ প্রায় ৯৫ হাজার, ২৭ মার্চ প্রায় ৭৫ হাজার, ২৮ মার্চ প্রায় ৭০ হাজার এবং ২৯ মার্চ প্রায় ৫০ হাজারের বেশি। এছাড়া ২৭ মার্চ সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে দিনশেষে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন ওয়েবসাইটে প্রায় ৪০ হাজার, ২৮ মার্চ প্রায় ৩৫ হাজার এবং ২৯ মার্চ প্রায় ৩৫ হাজার অনলাইন টিকেট বিক্রি করেছে সহজ। এখন পর্যন্ত নতুন ওয়েবসাইটে মোট নিবন্ধনকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখের বেশি। তারপরও কেনো বিপাকে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও সহজকে? কেনো সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে আছে?
মূলত, ১৫ বছরের পুরোনো ও অকার্যকর পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে রেলের টিকেট বিক্রির পরিচালনা আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে রেল কর্তৃপক্ষ যথাযথ দরপত্র প্রক্রিয়ায় সহজ নেতৃত্বাধীন নতুন প্রতিষ্ঠান সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি-কে দায়িত্ব সোপর্দ করে। জনদুর্ভোগ কমিয়ে স্বাচ্ছন্দে রেলের টিকেট কাটার বিষয়টি নিশ্চিৎ করতেই রেল কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ। কিন্তু এখানেও সমস্যা তৈরি করেছে আগের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিএনএস। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখ সহজ-এর সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ৭৭টি স্টেশনে গত ১৫ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসা সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার রেল কর্তৃপক্ষের কাছে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেবে সিএনএস। পাশাপাশি বুঝে নেয়া সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার নতুন প্রতিষ্ঠান সহজ-কে বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিলো রেল কর্তৃপক্ষের, যেনো সেগুলো দিয়ে টিকেটিংয়ের কাজ চলমান থাকে। কিন্ত ২১ কর্মদিবসের শেষ দিন এসে একটি সিডির মাধ্যমে সফটওয়্যার রেলের কাছে হস্তান্তর করে সিএনএস, যা কোনোভাবেই পেশাদারিত্বের মধ্যে পড়ে না। বাংলাদেশ রেলওয়ে, সহজ এবং সাধারন মানুষকে বিপাকে ফেলতেই এমন কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ রেলওয়ে ক্রমাগতভাবে সিএনএসকে শুরু থেকে যথাযথভাবে হস্তান্তরের বিষয়ে চাপ দিলেও তারা উদাসীন মনোভাব দেখিয়েছে। এছাড়া সিডির মাধ্যমে সফটওয়্যার হস্তান্তর করলেও তার সঙ্গে ছিলোনা কোনো প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, ছিলোনো হালনাগাদ কোনো তথ্য এবং মোবাইল অ্যাপ। শেষ সময়ে এসে হস্তান্তর করায় চরমভাবে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং সহজ।
সিএনএস যথাসময়ে সফটওয়্যার হস্তান্তর করছিলো না বলে মাত্র ২১ কর্মদিবসের মধ্যেই ৭৭টি স্টেশনে কম্পিউটারের মাধ্যমে টিকেটিংয়ের কাজ চলমান রাখার জন্যে নতুন সফটওয়্যার তৈরি করতে হয়েছে সহজকে। পাশাপাশি এই ২১ দিনের মধ্যেই টিকেট কাটার নতুন ওয়েবসাইটের কাজও করতে হয়েছে নতুন প্রতিষ্ঠানটিকে, যেনো দেশের মানুষ অনলাইনে রেলের টিকেট কাটতে পারে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ রেলওয়ে নিঃসন্দেহে দেশের জনগনের নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিকেট কেটে রেলপথ দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করে লাখো মানুষ। সেই ১৯৯৪ সালে কম্পিউটার ভিত্তিক টিকেটিং সিস্টেম চালু করা হয়। ২৭ টি স্টেশনে কম্পিউটারের মাধ্যমে টিকিট ইস্যু করা হতো। রেলওয়ের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ১০৪ টি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট ৭৭টি স্টেশনে কম্পিউটারের মাধ্যমে ইস্যু করা হচ্ছে। দৈনিক প্রায় ৯০ হাজার ও মাসিক প্রায় ২৭ লক্ষ যাত্রীর টিকিট কম্পিউটারের মাধ্যমে ইস্যু করা হয়। এ সকল টিকিটের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৩ লক্ষ টিকিট অনলাইনের মাধ্যমে ইস্যু করা হচ্ছে।
১৯৯৪ সাল থেকে শুরু করে ২০২২-এর ২০ মার্চ পর্যন্ত কম্পিউটার ভিত্তিক ও অনলাইনে টিকেটিং সিস্টেম পরিচালনার জন্য হাতেগোনা ২/১টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছিলো বাংলাদেশ রেলওয়ে। বর্তমান রেলপথ মন্ত্রীর ভাষ্যমতে, ভোগান্তি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু দেখতে পায়নি সাধারণ মানুষ। কারণ হিসেবে দেখতে গেলে প্রযুক্তিগত অক্ষমতা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনা। যদিও রেলপথ মন্ত্রীসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ও উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন রেলের সার্বিক উন্নয়নে। টিকেট নিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি যেনো না হয় সে লক্ষ্যে কাজ করছে রেল কর্তৃপক্ষ।