ক্রিমিয়া সেতুতে ধস, ইউক্রেনে উল্লাস

0
219

ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে রাশিয়া যুক্ত করা একমাত্র সেতুতে ভয়াবহ আগুন বিস্ফোরণে সেটির একাংশ ধসে পড়েছে। কার্চ সেতু নামে পরিচিত এই সেতুতে দুটো অংশ রয়েছে। একটি অংশে রয়েছে রেলপথ। অন্য অংশে যান চলাচল করে। শনিবারের বিস্ফোরণে সেতুর উভয় অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেতুর সড়ক অংশে।

একটি গাড়িবোমা ব্যবহার করে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তবে, তাৎক্ষণিকভাবে এর জন্য কাউকে দায়ী করা হয়নি। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ঘটনার বিস্তারিত জানানো হয়েছে এবং তিনি ঘটনা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দ্রুততম সময়ে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেসাথে এই বিস্ফোরণের ঘটনায় একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগ।

পুতিনের ঘনিষ্ঠ ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, ঘটনার তদন্তে একটি সরকারি কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। ওই কমিশনে থাকবেন ক্রিমিয়ার প্রধান, ন্যাশনাল গার্ড, ফেডারেল সিকিউরি সার্ভিস এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। বিস্ফোরণের পরপরই পরিবহনমন্ত্রী ও জরুরি পরিস্থিতি মন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

রাশিয়া-ক্রিমিয়ার মধ্যে স্থলসংযোগের একমাত্র মাধ্যমএই কার্চ সেতু। এটি কার্চ প্রণালীর ওপর নির্মিত এই সেতুটি প্রায় ১৯ কিলোমিটার লম্বা। এই অবকাঠামোকে ক্রিমিয়া ও দক্ষিণ ইউক্রেন অঞ্চলে রুশ আধিপত্যের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। এছাড়া, ইউক্রেনের দক্ষিণে রুশ সামরিক অভিযান টিকিয়ে রাখার অন্যতম চাবিকাঠিও এই কার্চ সেতু।

শনিবার ভোরের দিকে ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়াতে জুড়েদেয়া সেতুতে জ্বলানি ট্যাংকারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। প্রথমে একটিট্রাক বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। পরে চারটি তেলবাহী লরিতে এই আগুন ছড়িয়েপড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওটে। সেতুর ওপর দাউ দাউ করে ট্যাংকারটি জ্বলতে দেখাগেছে। বিস্ফোরণের অংশটি ধসে পড়েছে।

সমাজিক মাধ্যমে বিস্ফোরণ-পরবর্তী বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, কার্চ সেতুর যানচলাচলের অংশ মাঝ বরাবর ভেঙে পড়েছে। আর রেল চলাচলের অংশে একটি ট্রেনে জ্বলছে দাউদাউ আগুন। ওই অংশেই বিস্ফোরণটি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তখন সেতুর উপর দিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে যাচ্ছিলো একটি ট্রেন।

স্থানীয় সময় শনিবার ভোর ছয়টা নাগাদ বিকট শব্দে কেঁপেওঠে কার্চ সেতু। বহু দূর পর্যন্ত সেই আওয়াজ শোনা গিয়েছিলো। ভিডিওতে দেখা গেছে, সেতুর উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রেনের দু’টি কামরায় আগুন জ্বলছে। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে চারপাশ। তবে ঠিক কী কারণে এই সেতুতে বিস্ফোরণ হল, তা এখনও পরিষ্কার নয়।

২০১৮ সালে ১৯ কিলোমিটার কার্চ সেতুর যান চলাচলের অংশচালু করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। তার দুই বছর পর রেল পরিবহণের অংশটিও চালু করা হয়। আগুন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেই সেতু। এটি ব্যবহার করেই ক্রিমিয়াতে সামরিক রসদসহ অন্যান্য পণ্য পরিবহন করে থাকে রাশিয়া। সেতুতে বর্তমানে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় মস্কো। পরে ওই অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ বলে ঘোষণাও করা হয়। দক্ষিণ ইউক্রেনের এই অঞ্চলের সঙ্গে মস্কোর সরাসরি যোগাযোগের জন্য ২০১৮ সালে দুই লেনের এই সেতু উদ্বোধন করেন ভ্লাদিমির পুতিন। একটি লেন দিয়ে ট্রেন চলে। অপর লেনে চলে গাড়ি। রেলের অংশই ক্ষতি হয়েছে বেশি।

ঘটনার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক রাশিয়ার ক্ষতিকে ‘মাত্র শুরু’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে, সরাসরি ঘটনার জন্য ইউক্রেনের দায় স্বীকার করেননি। তিনি জানান, জানান, অবৈধ সবকিছু ধ্বংস করতে হবে, চুরি হওয়া সব কিছুই উক্রেনে ফেরত দিতে হবে, রাশিয়ার দখলে থাকা সবকিছু অবশ্যই নির্মুল করতে হবে।

ইউক্রেন সরকারের অফিসিয়াল টুইট বার্তায় আগুনের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছে, বিস্ফোরণের আগুন। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেতু বিস্ফোরণকে এপ্রিলে রাশিয়ার মস্কভা ক্ষেপণাস্ত্র ক্রুজার ডুবে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছে। টুইটে মন্ত্রণালয় জানায়, ইউক্রেনের ক্রিমিয়াতে রুশ শক্তির দুইটি কুখ্যাত প্রতীক হারিয়ে গেছে। এর পরে কি হবে?

পুতিনের ৭০তম জন্মদিন পালনের ঠিক পরদিন কার্চ সেতুতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলো। এই ঘটনার পর সোশাল মিডিয়ায় জ্বলন্ত সেতুর ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ইউক্রেনীয়দের উল্লাস করতে দেখা গেছে। তারা সেতুটিকে বিশেষভাবে ঘৃণা করে। অন্যদিতে ক্রিমিয়াতে যে কোন আক্রমণ ক্রেমলিনের জন্য অপমান হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক ও রেল চলাচল বন্ধ থাকায় রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড এবং উপদ্বীপের মধ্যে একটি ফেরি ব্যবস্থা চালু করবে বলে জানিয়েছে ক্রিমিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। ক্রিমিয়া পার্লামেন্ট স্পিকার ভ্লাদিমির কনস্টান্টিনভ বিস্ফোরণের জন্য ইউক্রেনীয় সন্ত্রাসীদের দায়ী করে বলেছেন, সেতুর ক্ষতি দ্রুত পুনরুদ্ধার করা হবে, কারণ এটিতে গুরুতর কিছু হয়নি।

২.৭ বিলিয়ন ডলারের কার্চ সেতু ইউরোপের দীর্ঘতম সেতু। রুশ মিডিয়া এটিকে ‘শতাব্দী সেরা অবকাঠামো’ বলেও প্রশংসা করেছে। রুশ কর্মকর্তারা পূর্বে দাবি করেছিলেন, এটি জল-স্থল এবং আকাশ পথ- সব দিকথেকেই যে কোন হুমকি থেকে সুরক্ষিত। ফলে শনিবারের বিস্ফোরণের পর পুরো ঘটনা ক্রেমলিন ভিন্ন দৃষ্টিতে বিশ্লেষন করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

রাশিয়ার তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে ক্রিমিয়া সেতুর গাড়ি চলাচলের অংশে বিস্ফোরণে একটি ট্রাক উড়ে গেছে। ক্রিমিয়াগামী ট্রেনের তেলবাহী ৭টি ট্যাংকেও আগুন ধরে যায়। সেতুর দু’টি অংশই ধ্বসে গিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এবারের যুদ্ধের আবহে রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রিমিয়াও ছিনিয়ে নিতে চাইছে ইউক্রেনীয় সেনারা।

সেতুর ক্রসিং ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে ১৬০ কিলোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত। একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, সম্ভবত ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে আগুন লাগেনি। রাস্তার পৃষ্ঠে সুস্পষ্ট বিস্ফোরণ বা খণ্ডিত ক্ষতির অভাব এটাই ইঙ্গিত দেয়, ঘটনায় আকাশপথে সরবরাহ করা কোনো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। সম্ভবত নিচ থেকে সুপরিকল্পিত হামলার কারণেও হতে পারে।

কার্চ ব্রিজ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার গাড়িচলাচল করে বলেও খবর। এই সেতু দিয়ে প্রতি বছর ১৪ মিলিয়ন যাত্রী এবং ১৩ মিলিয়ন টনকার্গো যাতায়াত করে। যদিও সেতুটি চালু হবার পর এই বিশাল অবকাঠামো নির্মাণকে অবৈধ হিসাবে ঘোষণা করে। যদিও রাশিয়ার এই ঘোষণা উড়িয়ে দিয়ে ক্রিমিয়াতে বিশাল সামরিকঘাঁটি গড়ে তুলেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here