শারমিন আক্তার ঝিনুক ওরফে ঝিনুক সওদাগর নামের মেয়েটির বর্তমান নাম জিবরান সওদাগর। শুধু নাম পরিবর্তন নয়, অস্ত্রোপচার করে ৩০ বছর বয়সী ঝিনুক এখন একজন পুরুষ। নারী-পুরুষের ফেরে রেলওয়ের চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না তিনি। এক নারীকে ভালোবাসলেও তিনি অন্য পুরুষকে বিয়ে করে সংসারি হয়েছেন।
দেশের ও ভারতের চিকিৎসকদের চিকিৎসাপত্রে লেখা আছে, জিবরান সওদাগর জেন্ডার ডিসফোরিয়ায় আক্রান্ত। ২০২০ সালে তিনি চিকিৎসার বিভিন্ন ধাপ শুরু করেন।
গতকাল সোমবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে জিবরান বলেন, ২০২১ সালে তিনি ভারত থেকে স্তন ও জরায়ু কেটে ফেলা, পুরুষাঙ্গ পুনঃস্থাপনসহ মোট তিনটি বড় অস্ত্রোপচার করেছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা। চাকরির কাগজপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টসহ বিভিন্ন নথিতে জিবরান এখনো শারমিন আক্তার ঝিনুক নামেই আছেন।
জিবরান বলেন, ‘আমি ছিলাম নারী। মাসিক হওয়াসহ সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যত বড় হচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম আমি অন্য ছেলে বা পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার চেয়ে নারীর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছি। স্কুলড্রেসের ওড়না পরতে বা মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালো লাগত না। একটা সময় একজন মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক হয়। চার বছর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেই মেয়ে চলে যাওয়ার পর মনে হয়, আমি পুরুষ হলে তো ও এভাবে চলে যেত না।
এরপর যাঁর সঙ্গে সম্পর্ক হয়, তাঁর পরিবার অস্ত্রোপচার করে পুরুষ হলে মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল বলে জানান জিবরান। তিনি বলেন, ‘কিন্তু অস্ত্রোপচার করে দেশে ফিরতে ফিরতে বুঝতে পারলাম, ওই মেয়েও এখন আর আমাকে চাচ্ছে না। পরে তার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়।’
অস্ত্রোপচারের আগে জিবরান বাংলাদেশ রেলওয়ের সৈয়দপুর ক্যারেজে ফিটার গ্রেড-২ পদে কর্মরত ছিলেন। ট্রেনের নম্বর লিখে কোনো ভাঙাচোরা কিছু আছে কি না, তার তালিকা দেওয়াসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয় এ পদে। জিবরান বলেন, ‘এ পদের যে কাজ, তাতে আমি নারী না পুরুষ, তাতে কিছু এসে যায় না। আমি যখন মেয়ে ছিলাম, তখনো বাইক চালাতাম। কঠিন কাজ করতে পারতাম। চট্টগ্রামে থাকার সময় রেলের চাকরিতে ক্রেনও চালিয়েছি।’
জিবরানের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শারমিন আক্তার ঝিনুক নামে ২০১২ সালে ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৮ বছরের একটু বেশি ছিল। বর্তমানে নারী থেকে পুরুষ হওয়ার পর সেই নামেই চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের জন্য ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি কর্মস্থলে বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে জিবরান বলেন, ‘আমি ক্রিকেট খেলতাম। তাই খেলার জন্য প্রায়ই আমি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতাম। অস্ত্রোপচারের জন্য লম্বা ছুটি লাগবে জানালে কর্তৃপক্ষ তার অনুমোদন দেয়নি। তবে আমি ছুটি চেয়েছি, কর্তৃপক্ষ তা মঞ্জুর করেনি, তার কোনো নথিপত্র নেই। তাই এ অভিযোগ আমি মেনে নিয়েছি।’
জিবরান বলেন, অস্ত্রোপচার করে দেশে ফেরার পর থেকে রাজধানীর রেল ভবন থেকে শুরু করে সৈয়দপুরে কর্মস্থলে চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য ঘুরছেন। তাঁর নিয়োগের ফাইল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছে বলে জানানো হয়।
গত মার্চ মাসেও বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক বরাবর কাজে যোগদানের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন জিবরান। তিনি বলেন, ‘আমি অস্ত্রোপচার করে নারী থেকে পুরুষ হলেও আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট, চোখের লেন্স তো একই আছে, চাকরিতে নিয়োগে সমস্যা কোথায়?’
জিবরান জানালেন, চিকিৎসকের সনদসহ আবেদন করার পর রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর শারমিন আক্তার ঝিনুককে ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তিনি দায়িত্ব পালনের জন্য ঠিক আছেন বা ফিট সনদ দেন। কিন্তু এরপরও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন টালবাহানা করছে।
জিবরান বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ড গঠিত হলে আমি বোর্ডের সদস্যদের সামনে সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করি। পরে বোর্ড সনদও দেয়। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আবার মেডিকেল বোর্ড গঠনের কথা বললে তখন আমি আপত্তি জানিয়েছি। আমি কেন বারবার আমার এই অবস্থার কথা জানাব?’
জানতে চাইলে আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, শারমিন আক্তার ঝিনুক নারী থেকে পুরুষ হয়েছেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তিনি দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। রেল ভবনে তাঁর সব কাগজ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন রেল ভবনের নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।
জিবরানের নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে রেল ভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. কামরুল আহসানের সঙ্গে রোববার দেখা করেছেন ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী হো চি মিন ইসলাম। তিনি তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, জিবরান ২০২১ সালে অস্ত্রোপচার করে দেশে ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরছে। জিবরান পুরুষ হয়েছেন, এ প্রমাণ দেখতে চান সবাই। দ্বিতীয়বার মেডিকেল বোর্ড গঠন করতে চেয়েছে কর্তৃপক্ষ। হো চি মিন ইসলাম আশাবাদ প্রকাশ করে লেখা শেষ করেছেন। জানিয়েছেন, মহাপরিচালকের টেবিলে জিবরানের ফাইল পৌঁছেছে এবং মহাপরিচালক জিবরানের নিয়োগের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।
জিবরানের বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি স্নাতক তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পরে আর পড়েননি। পারিবারিকভাবে তাঁরা স্বচ্ছল। পৈতৃক বাড়ি ও ব্যবসা আছে। তাঁর বাবা মারা গেছেন ২০১৪ সালে। বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। দুই মায়ের ঘরে তাঁরা ১২ ভাই–বোন। আগে ৯ বোন ছিলেন, এখন তিনি পুরুষ হওয়ার পর ৮ বোন।
জিবরান বললেন, ‘আমার ভেতরের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়টিতে আমার দুই মা এবং ভাইবোনদের সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছি। অস্ত্রোপচারের সময়ও দুই মা ও বোন টাকা দিয়েছেন। এখন চাকরি নেই, ভাইবোনেরা আমার খরচ দিচ্ছেন। আর আমরা দুই মায়ের সন্তান, তা কখনোই মনে করি না। চট্টগ্রামের বাড়িতে বাবা মারা যাওয়ার পরও দুই মা একসঙ্গেই থাকছেন। পারিবারিক সহায়তা না পেলে আমার জীবনটা অনেক কঠিন হয়ে যেত।’
জিবরান জানালেন, তাঁর বাবা মো. রফিকুল ইসলাম ব্যবসাসহ যেকোনো কাজে তাঁকে ভরসা করতেন। পাশে বসিয়ে ব্যবসা শিখিয়েছেন। বোনদের বিয়েবাড়িতে নিয়ে যাওয়া, রাতে দোকান থেকে কিছু আনার বেলাতেও তাঁকেই পাঠাতেন। ঈদে অন্য ভাইদের মতো শার্ট–প্যান্ট কিনে দিতেন।
জিবরান জানান, তাঁর মধ্যে পুরুষালি ভাব আগে থেকেই ছিল। বাবা ভরসা করতেন বলে সাহসটাও বেড়ে গিয়েছিল। ভালো ক্রিকেট খেলতেন বলে বড় ভাই প্রথমে তাঁর দলে খেলতে নেন। পরে মহিলা প্রিমিয়ার ফার্স্ট ডিভিশন, জাতীয় লিগে খেলেছেন। ২০১২ সালে চট্টগ্রামে ডিস্ট্রিক্ট টুর্নামেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে খেলেছেন। রেলওয়ের ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন হিসেবেও সুনাম অর্জন করেন।
জিবরান বললেন, ‘আগে মেয়ে হয়ে বাইক চালাতাম, ক্রিকেট খেলতাম, তা নিয়ে কথা শুনতে হতো। কেউ কেউ ভালো লাগার কথা বলে বাজে ইঙ্গিতও করতেন। আর এখন যখন কেউ শোনে অস্ত্রোপচার করে নারী থেকে পুরুষ হয়েছি, তখন পা থেকে মাথা পর্যন্ত একেকজন চোখ দিয়ে গিলতে থাকে। খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার।’
শুধু নারী থেকে পুরুষ হওয়ার কারণেই তাঁর কর্মক্ষেত্রের অনেকে বিষয়টি ভালোভাবে মেনে নিতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেন জিবরান। তিনি বলেন, ‘মানুষের চাহনির ভয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন নথিপত্র পরিবর্তন করতে যেতে ভয় পাচ্ছি। আসলে সমাজই আমাদের অসুস্থ করে ফেলে। রেলওয়েতে অনেকে সরাসরি বলেছেন, অস্ত্রোপচার করলেও আমাকে নারীর মতোই চলাফেরা করতে হবে।’
আপাতত চাকরি নেই, ভালোবাসার মানুষও নেই, সব মিলিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে জিবরান বললেন, ‘আমার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। আমি এখন সুখী একজন মানুষ। চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার পর বিয়েসহ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করব। তবে আমি পুরুষ হলেও আমি কখনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাবা হতে পারব না। আসলে বাবা হতে পারলাম কি না, তা আমার কাছে খুব বড় কোনো ব্যাপারও নয়।’\
সূত্র: প্রথম আলো