ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে স্ট্যান্ড রোড ভিক্টোরিয়া (এসআরভি) নামে একটি রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্দর থেকে খালাস হওয়া ভারী পণ্য বিশেষ করে সার ও পাথর এ স্টেশন থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়সহ বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হতো। ভারী যন্ত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে এই স্টেশনটিই ছিল প্রধান ভরসা। কিন্তু রেলের ইঞ্জিন, কোচের স্বল্পতাসহ নানা কারণে একসময় স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়।
এখন এটি মাদকসেবীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে গ্যারেজ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংস্কারের মাধ্যমে স্টেশনটি চালু করা গেলে রেলের আয় বাড়ার পাশাপাশি বন্দরের পণ্য পরিবহনে গতি আসবে। তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অর্থ বরাদ্দের বিষয় থাকায় এসআরভি স্টেশনটির সংস্কার আপাতত সম্ভব নয়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অধীন নগরের বাংলাবাজার এলাকার স্টেশনটিতে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ রুমেই তালা ঝুলছে। স্টেশন মাস্টার ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি। রেললাইনের ওপর বেশকিছু অকেজো বগি এবং তেলের ওয়াগন দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। ৬০ থেকে ৭০টি পণ্যবাহী বগি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। কিছু কিছু বগিতে গজিয়েছে পরগাছা। স্টেশনের জায়গা দখল করে বস্তি, ভ্রাম্যমাণ দোকান ও গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। একপাশে তৈরি হয়েছে পার্কিং স্পট, যেখানে দেখা গেছে ট্রাকের সারি।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এখানে কিছু যাত্রীবাহী পরিত্যক্ত বগি পড়ে আছে। সন্ধ্যা গড়াতেই সেগুলোতে বসে মাদকের আড্ডা। কেউ কিছু বললে মাদকসেবীদের আক্রোশের শিকার হতে হয়।
স্থানীয়দের তথ্যের সত্যতা মেলে স্টেশনটিতে দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাবিলদার নরেশ চন্দ্র মজুমদারের কথায়। তিনি বলেন, ‘স্টেশন এলাকায় সন্ত্রাসী, পকেটমার ও বখাটে ছেলেদের আড্ডা বেড়ে গেছে। সন্ধ্যার পর পরিত্যক্ত বগিতে মাদকের আড্ডা বসে। দেড় মাস আগে রাতে ডিউটি করার সময় দুর্বৃত্তরা আমাকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এখানে একজন হাবিলদার ও ৯ জন সিপাহি থাকার কথা। হাবিলদার হিসেবে আমি আছি। কিন্তু সিপাহি রয়েছেন মাত্র দুইজন। এভাবে ডিউটি করা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’
স্টেশন মাস্টার সৈকত দেবনাথ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এসআরভি রেলস্টেশনের জায়গাতে সরকারের লোকোশেড ও মাস্টারশেড (ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি মেরামতের জায়গা) তৈরির পরিকল্পনা ছিল। গত বছর বিভিন্ন দপ্তরের লোকজন কয়েক দফা এসে জায়গাও পরিমাপ করেছিল। এই শেড নির্মাণে সরকারের দরকার ছিল ১.৯ কিলোমিটার জায়গা। কিন্তু এসআরভিতে জায়গা আছে আরও বেশি, ২.৭ কিলোমিটার। এরপর আর কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসআরভি স্টেশন থেকে তাদের পণ্য পরিবহন করতে চেয়েছে। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে পণ্যবাহী কোচের ঘাটতি রয়েছে। কোচগুলো পেলে আগের মতো পুরোদমে এসআরভি স্টেশনটি চালু করা সম্ভব হবে।’
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে রেলপথে পণ্য আনা-নেওয়া করতে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকারের সমন্বয়হীনতার কারণে এই উদ্যোগ পুরোদমে চালু করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমরা ব্যবসায়ীরা ট্রাক, কাভার্ডভ্যানে করে পণ্য পরিবহন করতে বাধ্য হচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতিদিন ২০ হাজার পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করে। এ কারণে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রেল আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারত, আমেরিকা, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেলপথে পণ্য পরিবহন হচ্ছে। আমাদের দেশে এটা পুরোদমে চালু হলে ব্যবসায়ীরা নিরাপদে, কম খরচে পণ্য পরিবহন করতে পারতেন। এতে ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দামও কমে আসত।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও ট্রেইলারের মাধ্যমে বর্তমানে বন্দরের পণ্য পরিবহন করা হয়। আমরা চাই পণ্যগুলো রেলের মাধ্যমে যাক। রেল কর্তৃপক্ষ যদি এসআরভি স্টেশন, চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) স্টেশন পুরোদমে সচল করে তা হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ অবশ্যই সাধুবাদ জানাবে। আমরা রেলের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে চাই।’
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘রেলওয়ের যে সেক্টরগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এখন আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধা নিশ্চিত করা নিয়ে রেলওয়ে এখন কাজ করছে। কোনো জায়গা সংস্কার বা উন্নয়নের জন্য কাজ করতে গেলে অর্থ বরাদ্দের বিষয় থাকে। তাই আপাতত এসআরভি রেলস্টেশন নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। এটা পরে বিবেচনা করা হবে।’