ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার ময়নামতি, লালমাই উপজেলার লালমাই এবং আলীশহর এলাকার তিনটি রেলস্টেশন মুখ থুবড়ে পড়েছে। নান্দনিক নকশায় নির্মিত এসব স্টেশনে আছে সুবিশাল প্ল্যাটফরম, যাত্রীদের বসার বেঞ্চ।
এছাড়াও আছে অপেক্ষাগার, নারী-পুরুষদের পৃথক শৌচাগার, স্টেশন ম্যানেজারের অফিস, টিকিট বিক্রির কক্ষ, সার্ভার কক্ষ, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, পানির ট্যাংকসহ সব সুযোগ-সুবিধা। আছে স্টেশন পারাপারে দৃষ্টিনন্দন ফুটওভারব্রিজ। তবে আধুনিক মানের এসব স্টেশনে যাত্রীদের সেবায় সব আয়োজন থাকলেও থামে না ট্রেন, মিলে না যাত্রীসেবা।
বরং এসব স্টেশনের বিস্তীর্ণ প্ল্যাটফরম কৃষক-কৃষানিদের ধান মাড়াই-শুকানো এবং ছেলেমেয়েদের টিকটক ভিডিও করাসহ বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেখভালের অভাবে নষ্ট ও চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রপাতি। তবে নতুন স্টেশন নির্মাণে মন্ত্রী-এমপিদের অযাচিত ভূমিকা, পরিকল্পনায় ত্রুটি ও জনবল সংকটকে দায়ী করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তিনটি স্টেশন এলাকা ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের অনুমোদন হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দফায় সময় বৃদ্ধি করে ২০২৩ সালের ২০ জুলাই এ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
সরেজমিনে ময়নামতি রেল স্টেশনে গিয়ে রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেখা মেলেনি। এ স্টেশনটি দেখভাল করছেন ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্টেশনে কর্মরত আশরাফ আলী জানান, স্টেশনে রেলওয়ের কোনো কর্মচারী নেই, তাই তারা রাতে-দিনে ডিউটি করেন। তবুও যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় মাদ্রাসাশিক্ষক খিজির আহমেদ বলেন, ‘এ স্টেশনে কখনো ট্রেন থামতে দেখি না। এখানে কার স্বার্থে এতবড় স্টেশন তৈরি করা হলো জানি না।’
একই অবস্থা লালমাই রেলওয়ে স্টেশনের। স্টেশন মাস্টার কাজী আবদুল মান্নান জানান, ২০২১ সালের শেষ দিকে নতুন ভবনে এসেছেন। এখানে তিনিসহ তিন জন কর্মরত আছেন। এ স্টেশনে এখন শুধু লোকাল ট্রেন নাসিরাবাদ যাত্রাবিরতি দেয়। তবে জনবল সংকটে এখানে টিকিট বিক্রি হয় না।
আলীশহর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে করুণ দশা। স্টেশনের অফিসের দরজা-জানালা বন্ধ, রেলওয়ের কোনো কর্মচারী নেই। স্টেশনের প্ল্যাটফরমে ধান শুকাচ্ছেন এলাকার কৃষক-কৃষানিরা।
স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল আবেদীনসহ কয়েকজন জানান, বিশাল এ স্টেশন কোনো উপকারে আসে না। তবে ট্রেন না থামলেও এলাকার লোকজন ও স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এ স্টেশনটি একটি বিনোদনকেন্দ্রের মতো। এখানে ছেলেমেয়েরা ঘুরতে এসে মোবাইলে টিকটক ভিডিও করে।
আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইনের প্রকল্প পরিচালক মো. তানভিরুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন স্টেশন ও ডাবল রেললাইনের প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল সংকটে কিছু নতুন স্টেশন থেকে যাত্রীসেবা মিলছে না।’
রেলওয়ে কুমিল্লার সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিগন্যাল) আহমদ আলী বলেন, ‘ঐ তিনটি স্টেশন নিয়ে প্রতিদিন টেনশনে থাকতে হচ্ছে। গত এক বছরে এসব স্টেশন থেকে বেশকিছু পয়েন্ট মেশিন, জংশন বক্স ও ক্যাবল চুরি হয়ে গেছে।’
রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এ কে এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘জনবল নিয়োগ দেওয়ার পর ময়নামতি, লালমাই ও আলীশহর স্টেশনে কোনো ট্রেন থামানো যায় কি-না আমরা তা সমীক্ষা করব।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদীউজ্জামান বলেন, ‘রেলকে ঘিরে বিক্ষিপ্তভাবে উন্নয়ন হয়েছে। পরিকল্পনায় ত্রুটি ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের চূড়ান্ত উদাহরণ হলো জনবল চূড়ান্ত না করেই নতুন রেল স্টেশন তৈরি করা। যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের আগে কেন করা হবে-এ বিষয়ে বিষদ গবেষণা হয়। প্রয়োজন থাকলেই কেবল প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এখানে স্টেশন নির্মাণ হয়েছে অথচ কোনো কাজে আসছে না। অর্থ অপচয় করে এমন প্রকল্প মেনে নেওয়া যায় না।’