Monday, April 21, 2025

এক মাসে রেললাইন সিগন্যালের ২০ মোটর চুরি, গতি হারাচ্ছে ট্রেন

Must read

রেললাইনের সিগন্যাল মোটর চুরিতে অসহায় হয়ে পড়েছে রেলওয়ে। গত এক মাসে ২০টি মোটর চুরি হয়েছে। মেশিনের ভেতর থেকে মোটর চুরি করায় কম্পিউটার বেইজড সিগন্যাল পদ্ধতি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে ৪৫ বছর পিছিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে ট্রেন পরিচালনা করতে হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় ট্রেন থামিয়ে সিগন্যাল নিতে হচ্ছে বলে নির্ধারিত সময়ের বাইরে বিলম্বে পৌঁছাচ্ছে ট্রেন। বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের অনেক এলাকায় রেললাইনের সিগন্যাল পয়েন্টের মোটর চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় ট্রেন পরিচালনায় নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মোটর চুরি নিয়ে খুব পেরেশানিতে আছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। দিনের পর দিন মোটর চুরি বাড়ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২০টি মোটর চুরি হয়েছে।’

এসব মোটরের কাজ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোটরগুলো সিগন্যাল বক্সের সঙ্গে লাগানো থাকে। স্টেশন মাস্টার কম্পিটারের মাধ্যমে ট্রেন পরিচালনার জন্য ক্লিয়ারেন্স (সংকেত দিয়ে থাকেন। এখন মোটর চুরি হয়ে গেলে কম্পিউটার বেইজড সংকেত সিস্টেম (ইন্টারলকিং) কাজ করে না। তখন স্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পয়েন্টসম্যান এসে পয়েন্ট (এক লাইন থেকে অপর লাইনে স্থানান্তরের পয়েন্ট) ঠিক করে দেন। পয়েন্টসম্যান তখন কাগজের মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্স ট্রেনের লোকো মাস্টারকে (ট্রেন চালক) দেন। এই ক্লিয়ারেন্স পেলেই লোকো মাস্টার ট্রেন নিয়ে এগিয়ে যাবেন।’

রেলওয়ের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মুরাদ হোসেন বলেন, ‘এই মোটর চুরি নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। পাহাড়তলী, ফৌজদারহাট, ভাটিয়ারী পয়েন্টে প্রায় ২০টির মতো মোটর চুরি হয়েছে। এতে এসব স্টেশনের আউটারে চট্টগ্রাম-ঢাকা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম উভয়মুখী রুটের ট্রেনগুলোকে থামতে হয়। ফলে ট্রেনগুলোকে নির্ধারিত গন্তব্যে বিলম্বে পৌঁছতে হচ্ছে।’

কী পরিমাণ বিলম্ব হয় জানতে চাইলে কথা হয় রেলওয়ে রানিং স্টাফ কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম বলেন, ‘ইন্টারলকিং সিগন্যাল সিস্টেম অকার্যকর থাকলে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে চলমান একটি ট্রেনকে সনাতন পদ্ধতিতে সিগন্যাল ক্লিয়ারেন্স নিতে থামতে হয়। এই থামা আবার গতি বাড়াতে অতিরিক্ত ৬ থেকে ৭ মিনিট সময় নষ্ট হয়। এখন দুটি পয়েন্টে থামাতে হলে অতিরিক্ত প্রায় ১৪ মিনিট সময় লাগবে।’

এদিকে মোটর চুরির বাস্তব চিত্র দেখতে গতকাল সীতাকু-ের ভাটিয়ারী স্টেশনের আউটারে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমি গেইটের সামনে গিয়ে দেখা যায়, পয়েন্টসম্যান হাবিবুর রহমান চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর বিজয় এক্সপ্রেসকে থামানোর জন্য লাল পতাকা দেখাচ্ছেন। বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের সহকারী লোকো মাস্টার আকবর হোসেন সিগন্যাল নিয়ে ট্রেন চালিয়ে ফেনী অভিমুখে যান।’

মোটর চুরি প্রসঙ্গে পয়েন্টসম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, শুধু ভাটিয়ারী স্টেশনের ২৬/১, ২৬/বি, ২৪/এ, ২৪/বি, ২২/এ, ২২/বি পয়েন্টের ব্যাটারি খুলে নিয়ে গেছে। এতে এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে সিগন্যাল দেওয়া যায় না। আমরা রেললাইনের জয়েন্টে তালা মেরে পয়েন্ট সেট করে ট্রেন পরিচালনার ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছি। এতে মধ্যরাতেও ক্লিয়ারেন্স দিতে হলে আসতে হচ্ছে। কিন্তু যদি সিগন্যাল ঠিক থাকত তাহলে স্পটে আসার প্রয়োজন ছিল না।

কারা চুরি করছে এসব মোটর : ভাটিয়ারী স্টেশনের সহকারী মাস্টার নেছার উল্লাহ বলেন, ‘রাতের আঁধারে কারা চুরি করছে আমরা তো বলতে পারব না। তবে কোনো সিগন্যাল পয়েন্ট কাজ না করলে আমরা স্টেশনে বসেই শনাক্ত করতে পারি এবং পয়েন্টসম্যান পাঠিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে সিগন্যাল ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকি।’ তিনি আরও বলেন, আমাদের স্টেশনে গত ১৮ ডিসেম্বর প্রথমে দুটি, ২২ ডিসেম্বর আরও দুটি এবং সর্বশেষ ১ জানুয়ারি আরও দুটি মোটর চুরি হয়েছে।

ভাটিয়ারী এলাকা ঘুরে একটি ভাঙ্গারি দোকান পেয়ে কথা হয় সেই দোকানের মালিক নুরুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এসব মোটরের ভেতরে সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ টাকার তামার তার পাওয়া যেতে পারে। আর এসব মোটর অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। তবে আমাদের এখানে এগুলো কেউ বিক্রি করতে আসে না।’

পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এই মোটর অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বড়জোর  মোটরগুলো ভেঙে তামার তারগুলো বিক্রি করতে পারবে।

ভাটিয়ারী স্টেশনের আউটারে দাঁড়ানো ট্রেনের লোকো মাস্টার নাজমুল হোসেন বলেন, ইন্টারলকিং সিস্টেম না থাকায় দুই স্টেশনে আমার ১০ মিনিট সময় বাড়তি নষ্ট হয়েছে। ইন্টারলকিং সিস্টেম থাকলে ট্রেনের গতি সঠিকভাবে রাখা যায়।

এই ইন্টারলকিং সিস্টেম রেলওয়েতে কবে চালু হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে রেলওয়ের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে দীর্ঘদিন কাজ করা আবদুল বারী বলেন, ‘১৯৮০ সালে রেলওয়েতে প্রথম ইন্টারলকিং সিস্টেম চালু হয়। তখন থেকে রেললাইন, সিগন্যাল ও কম্পিউটার একসঙ্গে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে আসা হয়েছে। তা চালু হওয়ার পর স্টেশনের আউটারে গিয়ে আর পয়েন্টসম্যানদের সিগন্যাল ক্লিয়ারেন্স দেওয়া লাগে না। এখন ভাটিয়ারী বা যেকোনো জায়গায় ইন্টারলকিং সিস্টেম অকার্যকর থাকলে সনাতন পদ্ধতিতে সিগন্যাল ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৪০টি ট্রেন চলাচল করছে। সবগুলো ট্রেনকে এই পদ্ধতিতে ফৌজদারহাট ও ভাটিয়ারীতে থামতে হচ্ছে। এদিকে শুধু পাহাড়তলী, ভাটিয়ারী বা ফৌজদারহাট অংশেই নয়Ñ কুমিল্লার আলীশহর, ময়নামতি, শশীদল, রাজাপুর স্টেশন এলাকায়ও মোটর চুরির ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article