Monday, April 21, 2025

উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার ট্রেনের গতি বাড়লো

Must read

ইব্রাহিমাবাদ রেল স্টেশন। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে দূরত্ব ১১৬ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার জন্য প্রতিদিন ৩২ টি ট্রেন চলাচল করে। এই ৩২ টি ট্রেন যমুনা বহুমুখী সেতু অতিক্রম করার সময় ইব্রাহিমাবাদ রেল স্টেশনে প্রতিটি ট্রেনকে ১০ মিনিটের জন্য থামতে হয়। ট্রেনের প্রতিটি কোচের বগি, ভ্যাকুয়াম ব্রেক এবং স্পেয়ার পার্টস চেক করতে হয়। এই চেকিং করার পর ট্রেনটি যমুনা বহুমুখী সেতুর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেয়। সেতুতে ট্রেনটি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার বেগে চলে। ৪.৮ কিলোমিটার সেতু পাড়ি দিতে সময় লাগে ২২ মিনিট। সেতুর দুই প্রান্তে অন্যান্য ট্রেনের জট এবং শিডিউল মেনে চলে ট্রেনটি যমুনা পাড়ি দিতে ৪০ মিনিট থেকে ৫০ মিনিট লাগে। অনেক সময় ঘণ্টারও বেশি লাগে। এতে করে উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ ট্রেনের প্রতিদিন শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। যাত্রীদের দীর্ঘদিনের এই সমস্যার সমাধান হল মঙ্গলবার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যমুনা রেলসেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।

রেলসেতু উদ্বোধনের জন্য ৬ টি কোচ ও ২ টি লোকোমোটিভের সমন্বয়ে একটি বিশেষ ট্রেন অপেক্ষা করে ইব্রাহিমাবাদ স্টেশনে। হরেক রকমের ফুল ও রঙবেরঙের জর্জজেট কাপড় দিয়ে বিশেষ ট্রেনটি সুসজ্জিত করা হয়। ট্রেনটির লোকোমোটিভে দায়িত্ব পালন করেন লোকোমোটিভ মাস্টার (এলএম) মো: মনিরুজ্জামান, সহকারী এএলএম মো: ওসমান গনি এবং পরিচালক ছিলেন মো: সোহেল রানা। বেলা ১২ টা ১২ মিনিটে ট্রেনের পরিচালক সোহেল রানা তার বাঁশি ফুকিয়ে এবং সবুজ পতাকার নিশানা উড়িয়ে ট্রেনটি ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। তখন ট্রেনটিতে সওয়ার হয়েছেন রেল সচিব ফাহিমুল ইসলাম, রেল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন, যমুনা রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো: মাসউদুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম, ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত শাইদা শিনিচি, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক শরিফা হক, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, ভুয়াপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পপি খাতুন, জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক ইতো টেরুইকিসহ জাইকার ২০ জন কর্মকর্তা, যমুনা রেলসেতু নির্মাণ নিযোজিত শতাধিক জাপানি প্রকৌশলী, ওটিজে-জেভির প্রতিনিধিবৃন্দ, আইএইচআই-এসএমসিসি জেভির প্রতিনিধিবৃন্দ, ওসিজি-চোডাই-ডিডিসি জেভির প্রতিনিধিবৃন্দ এবং এলাকার প্রায় দুইশ বাসিন্দা। সব মিলিয়ে ৬শ যাত্রীকে নিয়ে বেলা ১২ টার ১৫ মিনিটে নবনির্মিত যমুনা রেলসেতুর প্রথম গার্ডার স্পর্শ করে। শুরুতেই ১০০ কিলোমিটার বেগে চলতে থাকা ট্রেনটি প্রায় ৩ মিনিটে রেলসেতু পাড়ি দিয়ে ওপারে ফয়দাবাদ রেলস্টেশনে পৌঁছে। তখন প্লাট ফরম শত শত মানুষ হাত তুলে ট্রেনটিকে অভিবাদন জানায়। অনেকেই ট্রেনকে লক্ষ্য করে ফুল ছুঁড়ে দেয়। এভাবেই গতকাল উদ্ধোধন হয়ে গেল ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের যমুনা রেলসেতু।

যমুনা রেলসেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৪.৮ কিলোমিটার দৈঘ্যের এ প্রকল্পটির ব্যয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশীয় উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা।

খোজ নিয়ে আরও জানান যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২ বছর বাড়ানো হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দাঁড়ায়। যার মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ দেশীয় অর্থায়ন এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিয়েছে এবং বাকি অর্থ সরকার দিয়েছে। জাপানের ওটিজি এবং আই এইচ আই যৌথভাবে সেতুটি নির্মাণ করেছে।

এর আগে ১৯৯৮ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন পারাপার হতো। এই সমস্যার সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।

২০২০ সালের ২৯শে নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি এই সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২১ সালের মার্চে পিলার নির্মাণের জন্য পাইলিং কাজ শুরু হয়। ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই রেল সেতু দেশের দীর্ঘতম প্রথম ডাবল ট্র্যাকের ডুয়েল গেজের সেতু। এটি ৫০টি পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যানে নির্মিত হয়েছে।

রেল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, যমুনা রেল সেতু দিয়ে ট্রেন পারাপারে আগের তুলনায় কম সময় লাগবে। এতে দুই পাড়েই সময় সাশ্রয় হবে। ডাবল লেনের সুবিধা পেতে হলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম বলেন, সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ সেতুর প্রতিটি স্প্যানের ওপর জাপানিদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হয়েছে। এর ফলে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রেল মন্ত্রনালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম বলেন, যমুনা বহুমুখী সেতু ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেতুতে রেলের লিঙ্ক প্রয়োজন দেখা দেয়ার পরে এই সেতুতে একটি সিঙ্গেল রেলসেতু সংযোজন করা হয়েছিল। যদিও এই সেতুটি রেলের জন্য প্রথমে বানানো হয়নি। এরপর থেকেই বাংলাদেশ সরকার অনুভব করেছে এই সেতুতে একটি ডেডিকেটেড রেল ব্রিজ প্রয়োজন সে তাগিদ থেকে এই সেতু নির্মিত হয়েছে। যমুনা রেল সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।

তিনি আরও বলেন, এখন থেকে এই রেল সেতু দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এই সুবিধা রেলের আয়বর্ধক কাজে ব্যবহৃত হবে। ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক যুক্ত হবার জন্য এই অঞ্চলের একটি দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা রয়েছে। আঞ্চলিক রেল নেটওয়ার্ক কানেক্টিভি বাড়ানোর জন্য এই রেল সেতুটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই সেতু দিয়ে প্রত্যেকটি ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি পাবেও। রেলওয়ে বিশেষ পয়েন্ট চার্জ প্রযোজ্য হবে। আগে সেতুতে পয়েন্ট চার্জ ছিল ১৬ দশমিক ৮ গুণ। এখন তা ২৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে। সেতুটি পুরোপুরি ইউটিলাইজ করতে হলে ইশ্বরদী- জয়দেবপুর ডাবল লাইন হতে হবে। এটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনার মধ্যে আছে। যাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধি করতে রেলওয়েতে নতুন কোচ এবং লোকমোটিভ কেনার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যমুনা রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে রেলপথ সচিব বলেন, এখন পর্যন্ত এমন কোন অভিযোগ আসেনি ভবিষ্যতে আসলে তা খতিয়ে দেখা হবে।

এদিকে, যমুনা রেলসেতুর দুই প্রান্তে ফয়দাবাদ ও ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশন দুইটি রিমডেলিং করা হয়েছে। স্টেশন দুইটিতে পৃথক ৮ টি রেলট্র্যাক স্থাপন করা হয়েছে। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ১৮০ কিলোমিটার রেলপথ সিঙ্গেল লাইন। এ কারণে যমুনা রেলসেতু অতিক্রম করতে দুইটি স্টেশনকে রিমডেলিং করা হয়েছে বলে রেল অধিদপ্তর।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article