দেয়াল লিখন কিংবা পোস্টার লাগানোর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই খোদ রাজধানী ঢাকায়। এই সুযোগে সরকারি স্থাপনা, মেট্রোরেলের পিলার থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির দেয়ালে যেমন খুশি তেমন করে লাগানো হচ্ছে পোস্টার। এতে একদিকে লঙ্ঘন হচ্ছে আইন, অন্যদিকে হচ্ছে সৌন্দর্যহানি।
নগরসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি আছেন যারা পুরো ঢাকাজুড়েই পোস্টারিং করে বেড়ান। এদের মধ্যে জাতীয় পার্টির নেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বিশাল আকৃতির পোস্টার সাঁটিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। পোস্টার বয় হিসেবেও আখ্যা পেয়েছেন। এবার ঢাকায় খোঁজ মিলেছে নতুন পোস্টার বয়ের। পেশায় হোমিও চিকিৎসক হলেও নিজেকে ক্যান্সার গবেষক হিসেবে দাবি করা মানুষটির নাম ডা. এস এম সরওয়ার। যিনি মেট্রোরেলের পিলার থেকে শুরু করে সরকারি স্থাপনার দেয়াল পোস্টার দিয়ে ভরে ফেলছেন। অবশ্য পোস্টারে পরিচয় দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী যুব সেনার কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে।
পোস্টারে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার (২৬ এপ্রিল) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানাতে গণজমায়েত কর্মসূচি পালন করা হবে। যেখানে বিভিন্ন ইসলামিক দল, সংগঠন ও একাধিক পীর সাহেবদের ভক্ত-মুরিদরাও অংশ নেবেন। এস এম সরওয়ারের এই পোস্টার সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে লাগানো হয়েছে।
যার পোস্টার তিনি অবশ্য বলছেন, সবাই যেখানে পোস্টার লাগায় আমিও লাগিয়েছি। এতে দোষের কি আছে?
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আইনের প্রয়োগ এবং শাস্তির বিধান শক্ত না হওয়ায় মানুষ এভাবে শহরের সৌন্দর্যহানি করার সুযোগ পাচ্ছে। যারা এমনটা করছেন তাদের বোধশক্তিও অনেকটা কমে আসছে। না হলে বিবেকের তাড়নায় হলেও এই যুগে এসে তারা এমনভাবে পোস্টারিং করতেন না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পল্টন মোড় থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাওয়ার পথে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়াল, মেট্রোরেলের সবগুলো পিলারে যতদূর চোখ যায় ডা. এস এম সরওয়ারের পোস্টার শোভা পাচ্ছে। পিলারগুলোর দক্ষিণ এবং উত্তর পাশ পুরোটা পোস্টারে ছেয়ে গেছে।
শুধু তাই নয়, প্রেসক্লাবের সামনে মেট্রোরেলের সিঁড়ির পাশের সব ফাঁকা জায়গায় লাগানো হয়েছে পোস্টার। প্রেসক্লাবের উল্টো পাশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়ালজুড়েও শোভা পাচ্ছে সারওয়ারের এই পোস্টার। সেগুনবাচিগায় ঢোকার মুখেও লাগানো হয়েছে এই কর্মসূচির পোস্টার।
অবশ্য এসব জায়গায় শুধু তার একার নয়, আরও অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের পোস্টারও শোভা পাচ্ছে। তবে তার সৌজন্যে পল্টন মোড় থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত কয়েকশ’ পোস্টার এমনভাবে লাগানো হয়েছে যাতে যে কারও নজরে আসবে।
প্রেসক্লাবের সামনে মোশারেফ হোসেন নামে একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা বলেন, ন্যূনতম রুচিবোধ থাকলে কোনো মানুষ এভাবে পোস্টার লাগিয়ে সৌন্দর্যহানি করতে পারে না। এদের ধরে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। প্রয়োজনে তাকে দিয়েই পোস্টার অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে মেট্রোরেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে বিষয়টি কঠোরভাবে দেখভালের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর মেট্রোরেলের কোথায় কি লাগানো হচ্ছে, রং করা হচ্ছে এটা খুব একটা দেখা হচ্ছে না। অথচ নিয়ম অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া পোস্টার লাগানোর কোনো সুযোগ নেই।
কী বলছেন পোস্টারে ঢেকে দেওয়া সরওয়ার?
এমন করে পোস্টার লাগানো নিয়ে জানতে চাইলে এস এম সরওয়ার বলেন, পোস্টার কোথায় লাগানো হয়েছে সেটা তো আমি জানবোই; আমিই তো লাগাতে বলেছি। সবাই যেখানে পোস্টার লাগায় আমিও লাগিয়েছি। অন্য সব দল, সংগঠনও তো পোস্টার করে। যেখানে পোস্টার পেয়েছি সেখানেই লাগানো হয়েছে। এতে সমস্যার কি আছে?
কর্মসূচি উপলক্ষে ২ হাজার পোস্টার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনারা সাংবাদিকরা কি অন্য কোনো কাজ পান না? এই কাজ নিয়ে পড়ে আছেন।
পোস্টার লাগানোর ক্ষেত্রে আইন আছে। সেটা আপনি জানেন কিনা- এমন প্রশ্ন করতেই চটে যান এই হোমিও চিকিৎসক। রেগে গিয়ে তিনি বলেন, পোস্টার লাগাব; সেটার আবার আইন আছে, সেটাও জানাচ্ছেন আমারে? বলেন আইনটা কি? আপনাদের (সাংবাদিক) আর কোনো কাজ নেই? আমি নিজেও সাংবাদিক!…. ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।
Poster1
পোস্টার লাগানো নিয়ে আইনে কী আছে?
ঢাকাজুড়ে পোস্টার-দেয়াল লিখনে ভরে গেলেও দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন আছে। যেখানে এমন কাজ করলে তার শাস্তিরও বিধান আছে।
দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২’র ৪ ধারায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে।
আইনের ‘৩’ ধারায় বলা হয়েছে, ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে না। আইনের ‘৬’ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাবে।
কী বলছে সিটি করপোরেশন?
পোস্টার লাগানোর বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. মাহাবুবুর রহমান তালুকদারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পরে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রাসেল রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে মাঝেমধ্যে পোস্টার-ফেস্টুন অপসারণে অভিযান চালানো হয়। তবে এটা যেহেতু মেট্রোরেলের স্থাপনা তারা এটি দেখবেন। তারপরও বিষয়টি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগকে অবহিত করা হবে।
‘আইন ও শাস্তি দুর্বল হওয়ায় মানুষ সুযোগ নিচ্ছে’
উল্লিখিত আইনসমূহ ভীষণ দুর্বলভাবে প্রয়োগ করা হয়। শাস্তিও দুর্বল। সিটি আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মেট্রোরেলের পিলার পুরোপুরি ঢেকে দিয়ে যেভাবে পোস্টার লাগানো হয়েছে এটা তো দৃষ্টিদূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা। এই যুগে এসে মানুষের মনের ভেতরে প্রবেশের জন্য এমন করে কীভাবে বুঝতে পারি না। সবার আগে পোস্টার লাগানোর তো একটা আইন আছে। সেই আইনটা ভীষণ দুর্বলভাবে প্রয়োগ করা হয়। শাস্তিও দুর্বল। মানুষ এর সুযোগ নিচ্ছে। সিটি করপোরেশনের উচিত এটি কঠোরভাবে মনিটরিং করা।
তিনি আরও বলেন, আইন ভেঙে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করার জন্য রাষ্ট্রীয় সিস্টেমেও কঠোর শাস্তি নেই। স্যোশাল পানিসমেন্টও নেই। এটা থাকলে এমন কাজ করার আগে শতবার চিন্তা করে নিতে হতো।