Wednesday, October 22, 2025

রেলওয়ে নিয় ভাবনা

Must read

মোহাম্মদ সেলিম পাটোয়ারী :

১৯৮৯ সালে ক্যালোকা বা কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার নিম্নমান কাজ শুরু হয়। কারখানার কার্যক্রম ১৪ মে ১৯৯২ সালে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে শুরু হয়। বর্তমানে এটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কারখানাটি ১১১ একর বা ৪৫ হেক্টর আয়তনের স্থানে অবস্থিত, যার মধ্যে কারখানার নিজস্ব এলাকা ২৮ একর এবং আবাসিক এলাকা ৮৩ একর। এখানে অনুমোদিত লোকবল ৭২৪ জন, কর্মরত বা অনরোল ২৩৯ জন। মেশিনারিজের সংখ্যা ৩৬৭টি এবং সেকশন ১২টি।

আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলছি, এখানে কেবল মেরামত নয়, বরং বিদেশ থেকে আমদানি করা সকল লোকোমোটিভ সংযোজন বা এসেম্বল করার সুযোগ থাকলে দেশের ঋণ সাশ্রয় হতো এবং দেশীয় প্রযুক্তির শক্তি বৃদ্ধি পেত।বাংলাদেশ রেলওয়ে দীর্ঘদিনের সংকটময় বাস্তবতার মুখোমুখি। কখনো ইঞ্জিন বিকল, কখনো লাইনচ্যুত হওয়া, কখনো বগি বিচ্ছিন্ন হয়ে চলন্ত ট্রেনকে বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া—এসব যেন এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সভা-সেমিনার কিংবা কর্মকর্তাদের কাগজের পরিকল্পনা—এসবের মধ্যে দিয়ে বাস্তব সংকট নিরসন হচ্ছে না। বরং রেলওয়ের যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা ও অনিয়ম-দুর্নীতির বেড়াজালে প্রতিষ্ঠানটি আরও গভীর সংকটে ডুবে যাচ্ছে।এই অবস্থায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে পার্বতীপুরে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা (CLW-2) নির্মাণের উদ্যোগ। বিদ্যমান লোকোমোটিভ কারখানার পাশাপাশি ২৫ একর জমিতে প্রায় ২,৯০০ কোটি টাকায় আরেকটি সমপর্যায়ের কারখানা গড়ে তোলার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, নতুন কারখানা তৈরি হলে ইঞ্জিন মেরামত, জিওএইচ, বিশেষ মেরামত ও রিলিফ ট্রেনের কাজ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। এতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে প্রায় ৭৫০ জনের।

প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৃত প্রয়োজন কি নতুন লোকোমোটিভ কারখানা, নাকি নতুন ইঞ্জিন, নতুন কোচ এবং ট্রেন পরিচালনার জন্য কার্যকর রেললাইন সংস্কার?

বিদ্যমান কারখানার বাস্তব অবস্থা:

পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় প্রতিবছর অন্তত ৫১টি লোকোমোটিভ জেনারেল ওভারহোলিং (GOH) করার প্রয়োজন। কিন্তু সক্ষমতার ঘাটতি ও দায়িত্বহীন ও অব্যবস্থাপনার কারণে ওভারহোলিং হয় মাত্র ২১টি। অর্থাৎ টার্গেটের অর্ধেক কাজই সম্পন্ন হয় না।

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে—বিদ্যমান কারখানায় নিয়মিত দুর্নীতি, অদক্ষতা, যন্ত্রাংশ কেনাবেচায় অনিয়ম এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতৃত্বের দৌরাত্ম্যের কারণে কার্যক্রম সচল থাকে না। ফলে যে প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব, সেটি আজ “অর্ধেক সক্ষমতার” কম নিয়েই টিকে আছে।এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে—যে কারখানাটি শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি, সেটির সংস্কার, দুর্নীতি-অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দমন না করে নতুন কারখানা বানিয়ে কী লাভ হবে?

নতুন প্রকল্প নাকি নতুন অপচয়?

নতুন CLW-2 নির্মাণে আনুমানিক ২,৯০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ বিপুল অর্থে নতুন কারখানা গড়ে তোলার চেয়ে নতুন লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ও আধুনিক কোচ কেনা কি দেশের জন্য বেশি জরুরি নয়?

বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট লোকোমোটিভ সংখ্যা মাত্র ৩০৬টি। এদের একটি বড় অংশ পুরনো এবং প্রায়শই অচল হয়ে পড়ে। প্রতিদিন চলাচলরত অসংখ্য ট্রেন সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না কেবল ইঞ্জিন বিকল বা যান্ত্রিক সমস্যার কারণে। যাত্রী হয়রানি, অর্থনৈতিক ক্ষতি, এবং রেলওয়ের প্রতি জনগণের আস্থা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের দিকে।

সুতরাং—

যদি নতুন লোকোমোটিভ কেনা হয়, সরাসরি ট্রেন চলাচল উন্নত হবে।

যদি আধুনিক কোচ আনা হয়, যাত্রীসেবার মান বাড়বে এবং আস্থা ফিরে আসবে।

যদি রেললাইন সংস্কার করা হয়, দুর্ঘটনা ও লাইনচ্যুতির প্রবণতা কমবে।

কিন্তু নতুন লোকোমোটিভ কারখানা নির্মাণ এসব সমস্যার কোনোটিরই সরাসরি সমাধান নয়। বরং এ উদ্যোগ আবারও “প্রকল্পনির্ভর অপচয়” এবং দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

আসল সমস্যা: দায়িত্বহীনতা, কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও দুর্নীতি-

রেলওয়ের সংকটের মূল শিকড় নিহিত রয়েছে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে। কর্মকর্তাদের পদোন্নতি-বদলি নিয়ে দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব, সৎ যোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবমূল্যায়ন, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত।

নতুন কারখানা নির্মাণ করলে যদি একই দুর্নীতি, অযোগ্যতা, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা চলতে থাকে, তাহলে CLW-2 ও CLW-1 একই ভাগ্যভোগ করবে। কয়েক বছর পর আমরা আবার শুনব—”কারখানা সক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার হচ্ছে না”, “যন্ত্রাংশ নেই”, “লোকবল নেই”, “বাজেট নেই”।

তাহলে কি এ উদ্যোগ প্রকৃতপক্ষে রেলওয়ের উন্নয়ন, নাকি নতুন একটি “প্রকল্পের নামে দুর্নীতির সুযোগ”?

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট:

রেলওয়ে সংস্কার কিভাবে হয়?
ভারত, চীন বা ইউরোপীয় দেশগুলোর উদাহরণ থেকে দেখা যায়—

তারা নতুন কারখানা নির্মাণের আগে বিদ্যমান অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে।

রেললাইন সংস্কার ও সিগন্যালিং আধুনিকায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।

নতুন ইঞ্জিন ও কোচ ক্রয়কে যাত্রীসেবার জন্য অপরিহার্য মনে করে।

বাংলাদেশে রেলওয়ে বরং উল্টো পথে হাঁটছে। মূল সমস্যার সমাধান না করে নতুন প্রকল্পে ব্যস্ত। এটি হতে পারে ম্যাগাপ্রজেক্ট ও ম্যগাদুর্নীতির উদাহরণ।

সমাধান: করণীয়

১. বিদ্যমান কারখানার আধুনিকায়ন ও দুর্নীতি দমন

★CLW-1 পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালিত হলে প্রতিবছর ৫০টির বেশি লোকোমোটিভ ওভারহোলিং সম্ভব।

★অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে নতুন কারখানার প্রয়োজনও হ্রাস পাবে।

২. নতুন লোকোমোটিভ ও কোচ সংগ্রহ

★অন্তত ২০০ নতুন ইঞ্জিন এবং এক হাজার (১০০০) আধুনিক কোচ জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করা।

৩. রেললাইন সংস্কার ও সিগন্যালিং আধুনিকায়ন

★দুর্ঘটনা রোধে জরাজীর্ণ রেললাইন প্রতিস্থাপন এবং ডিজিটাল সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু করা।

৪. কৌশলগত পরিকল্পনা ও স্বায়ত্তশাসন

★রেলওয়েকে প্রশাসনিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করে কারিগরি প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা ফিরিয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন কেবল নতুন প্রকল্প বা বিলাসবহুল কারখানায় নয়, বরং কার্যকর ব্যবস্থাপনা, অনিয়ম দমন, এবং যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার মধ্যেই নিহিত।

পার্বতীপুরে দ্বিতীয় লোকোমোটিভ কারখানা গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে একটি বড় উদ্যোগ, কিন্তু এটি রেলওয়ের প্রকৃত সংকট সমাধান করবে না। বরং এই মুহূর্তে রেলওয়ের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন—নতুন ইঞ্জিন, আধুনিক কোচ, কার্যকর রেললাইন সংস্কার এবং বিদ্যমান অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহার।নতুন কারখানা যদি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক লুটপাটের নতুন কেন্দ্র হয়ে ওঠে, তাহলে এর ফল ভুগতে হবে গোটা জাতিকে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে, প্রকল্পের চকচকে খোলস দেখে নয়। নতুবা, ২,৯০০ কোটি টাকার নতুন কারখানাও রেলওয়ের অচলাবস্থার আরেকটি “স্বেত হস্তি” হয়ে দাঁড়াবে।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article