Wednesday, October 22, 2025

‘পর্দা কেলেঙ্কারি’ থেকে শিক্ষা: রেলওয়ের দুর্নীতিতে দায়মুক্ত ঠিকাদারদের জবাবদিহি কবে হবে?

Must read

মনিরুজ্জামান মনির :

বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্নীতির ইতিহাসে ‘পর্দা কেলেঙ্কারি’ এখন এক প্রতীকী শব্দে পরিণত হয়েছে—যেখানে একটি ৮৮ হাজার টাকার পর্দা রাষ্ট্রীয় অপচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। রাজশাহী রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল অফিসের ২০১৮–১৯ অর্থবছরে সংঘটিত এই ঘটনাটি আজ আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৫ অক্টোবর ২০২৫-এ দীর্ঘ ছয় বছর পর এই ঘটনায় মামলা করেছে।

কিন্তু সময়ের ব্যবধানের বাইরেও একটি নতুন প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে—দুর্নীতির এই ঘটনায় পণ্য সরবরাহকারী ঠিকাদাররা দায়মুক্ত কেন?

মামলা পুরনো, কিন্তু প্রশ্ন নতুনঃ

দুদকের মামলায় পশ্চিম রেলের সাবেক দুই মহাব্যবস্থাপকসহ (জিএম) ১৮ জন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তারা অনুমোদিত ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে বাজারমূল্যের তুলনায় ১৫ থেকে ৩৩ গুণ বেশি দামে পণ্য কিনে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

তবুও মামলার তালিকায় একটিও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। এখানেই তৈরি হয়েছে প্রশ্ন—যদি কর্মকর্তারা যোগসাজশে অপরাধ করে থাকেন, তাহলে যোগসাজশের অপরপক্ষ—ঠিকাদাররা—কেন বাদ পড়বে?

সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী (Public Procurement Rules, 2008), পণ্য সরবরাহের প্রতিটি ধাপে ক্রেতা (সরকারি কর্মকর্তা) ও সরবরাহকারী (ঠিকাদার) উভয়ের মধ্যে দায়-দায়িত্ব ভাগ করা থাকে। অর্থাৎ, কোনো আর্থিক অনিয়ম বা অতিমূল্যের ক্রয়ে উভয় পক্ষকেই তদন্তের আওতায় আনা উচিত।

তাহলে প্রশ্ন জাগে—দুদকের মামলা কি আংশিক? নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু নাম বাদ দেওয়া হয়েছে?

ঘটনার ভয়াবহ আর্থিক চিত্রঃ

দুদকের এজাহার অনুসারে, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন দপ্তরে অস্বাভাবিক দামে পণ্য কেনা হয়। উদাহরণ হিসেবে:

একটি ভিআইপি পর্দা কেনা হয় ৮৮,৮২৬ টাকায়, মোট ৫০টি পর্দায় ব্যয় ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৩০০ টাকা। ১৭৩ টাকার তালা কেনা হয়েছে ৫,৫৯০ টাকায় ২৬০ টাকার বালতি কেনা হয়েছে ১,৮৯০ টাকায়। ৯৮ টাকার ঝাড়ু কেনা হয়েছে ১,৪৪০ টাকায়।

মোট আত্মসাৎ করা হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ ১৪ হাজার ১৯৬ টাকা।

এই অর্থ আত্মসাৎ একটি স্বতন্ত্র নয়—বরং রেলওয়ের দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক অদক্ষতা, তদারকির অভাব এবং দুর্নীতির সংস্কৃতির ধারাবাহিক ফল।

দায়িত্বের বৃত্ত ভাঙা: কর্মকর্তারাই কেন একমাত্র টার্গেট?

যে প্রক্রিয়ায় সরকারি টেন্ডার কার্যকর হয়, তা একাধিক স্তরে ভাগ করা—প্রাক্কলন কমিটি, দরপত্র আহ্বানকারী কর্তৃপক্ষ, দর মূল্যায়ন কমিটি, অনুমোদনকারী কর্মকর্তা এবং শেষত সরবরাহকারী ঠিকাদার।

তদন্তে জানা গেছে, প্রাক্কলন কমিটি বাজারদর যাচাই না করেই অতিরিক্ত দর নির্ধারণ করে টেন্ডার আহ্বান করেছে, এবং মূল্যায়ন কমিটি কোনো যাচাই ছাড়াই সেটি অনুমোদন দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় যেসব ঠিকাদার দরপত্রে অংশ নিয়েছেন, তারাও জানতেন বাজারদরের তুলনায় মূল্য অস্বাভাবিক।

অর্থাৎ, এখানে এককভাবে কোনো কর্মকর্তা নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক কাজ করেছে—যেখানে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

কিন্তু মামলায় সেই ঠিকাদারদের নাম অনুপস্থিত। এটি আইনের শাসনের জন্য যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি জনবিশ্বাসের জন্যও ক্ষতিকর।

আইন বিশেষজ্ঞদের স্পষ্ট ব্যাখ্যাঃ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন অনুষদের অধ্যাপক বলেন,

“দুদক যদি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যোগসাজশের কথা স্বীকার করে, তবে সরবরাহকারীকে বাদ দেওয়া আইনের পরিপন্থী। ক্রয়বিধি ২০০৮-এর ১২৩ ধারায় বলা আছে—সরকারি অর্থ অপচয়ের ঘটনায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের দায় নির্ধারিত হবে। এটি যৌথ অপরাধ।”

আরও বলেন,

“দুদক মামলা দায়ের করেছে ছয় বছর পর। এটি স্পষ্ট করে যে তদন্ত প্রক্রিয়ায় গাফিলতি ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। সময়ক্ষেপণের ফলে অনেক ঠিকাদার হয়তো রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন, তাই তাদের নাম বাদ যেতে পারে।”

দেরিতে বিচার, বাড়ে অবিশ্বাসঃ

এই মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সময়কাল। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে সংঘটিত অপরাধের মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে, অর্থাৎ প্রায় ছয় বছর পরে।

এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান শুধু প্রমাণ সংগ্রহকে দুর্বল করে না, বরং দুর্নীতিবাজদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও তৈরি করে। এ ছাড়া, এত দেরিতে মামলা হলে জনমনে সন্দেহ জন্মায়—তদন্ত কি শুধুই আনুষ্ঠানিকতা?

বর্তমান প্রশাসন দায়ী নয়—তবু চাপ তাদের ওপরঃ

দুদক ও রেলওয়ের সূত্র অনুযায়ী, বর্তমান পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এটি সম্পূর্ণভাবে পূর্ববর্তী কর্মকর্তাদের আমলে সংঘটিত দুর্নীতি।

তবু মিডিয়া কাভারেজের কারণে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে—অনেকে মনে করছেন, এটি বর্তমান কর্মকর্তাদের সময়ের ঘটনা।

একজন সিনিয়র রেল কর্মকর্তা বলেন,

“আমরা চাই, অতীতের দুর্নীতির বিচার হোক দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে। কিন্তু সেই সঙ্গে ঠিকাদারদের দায়ও স্পষ্ট করা জরুরি—কারণ সরকারি টাকার অপচয় একা কেউ করতে পারে না।”

প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির সংকটঃ

বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সংস্থা—প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার সম্পদ, ৩৬ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করে। কিন্তু এই বিশাল প্রতিষ্ঠানে কার্যকর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বা স্বচ্ছতা ব্যবস্থাপনা নেই।

যে কারণে “বালতি কেলেঙ্কারি” থেকে “ইঞ্জিন ক্রয় দুর্নীতি”—সবক্ষেত্রেই দেখা যায় একই ধাঁচের যোগসাজশ: কর্মকর্তা + ঠিকাদার + তদারকি ব্যর্থতা।

‘পর্দা কেলেঙ্কারি’ সেই একই ধারাবাহিকতার পুনরাবৃত্তি, যা কেবল নাম বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি।

ঠিকাদাররা দায়মুক্ত কেন? একটি গভীর বিশ্লেষণঃ

১. আইন প্রয়োগে বৈষম্য:
দুদক প্রায়ই শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে মামলা করে, ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে নয়। এটি একটি প্রশাসনিক ‘Safe Zone’ তৈরি করেছে, যেখানে বেসরকারি অংশীদাররা রাজনৈতিক বা প্রভাববলয়ের আশ্রয়ে থেকে দায় এড়ায়।

২. রাজনৈতিক প্রভাব:
অনেক ঠিকাদার স্থানীয় রাজনীতি ও নির্বাচনী অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে মামলা মানেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, যা তদন্তকারীরা এড়াতে চান।

৩. তদন্তে তথ্য ঘাটতি:
ঠিকাদারদের ব্যাংক লেনদেন বা অর্থ প্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন, কারণ বেশিরভাগ লেনদেন মধ্যস্বত্বভোগী বা ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে হয়।

৪. দুদকের কাঠামোগত দুর্বলতা:
দুদক আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের অপরাধ প্রমাণের জন্য অনুমোদন বা Prosecution Sanction প্রয়োজন হয়, কিন্তু ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে তদন্তের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট নয়। ফলে, তদন্তকারীরা প্রায়ই “সরকারি অংশ” নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেন।

স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে করণীয়ঃ

১. সরকারি ক্রয়ে যৌথ দায়নীতি:
আইন সংশোধন করে টেন্ডার দুর্নীতিতে ক্রেতা ও ঠিকাদার উভয়ের দায় নির্ধারণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

২. ডিজিটাল টেন্ডার মনিটরিং:
সকল সরকারি টেন্ডার অনলাইন ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনতে হবে, যাতে দরের পার্থক্য ও বাজারমূল্যের তুলনা তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যায়।

৩. দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা:
দুদককে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। বিশেষত রেল, বিদ্যুৎ ও সড়ক খাতে বিশেষ শাখা স্থাপন জরুরি।

৪. পাবলিক হিয়ারিং প্রথা চালু করা:
বড় ক্রয় ও প্রকল্পে জনগণের অংশগ্রহণমূলক শুনানি বাধ্যতামূলক করা হলে অনিয়মের সুযোগ কমে।

৫. রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শক্তিশালী করা:
প্রতিটি বিভাগে নিরীক্ষা সেল স্থাপন করে ত্রৈমাসিক রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।

ঘটনার সারসংক্ষেপঃ

বিষয় বিবরণ

সময়কাল ২০১৮–১৯ অর্থবছর
মামলা দায়ের ১৫ অক্টোবর ২০২৫
আত্মসাতের পরিমাণ ২ কোটি ১৮ লাখ ১৪ হাজার ১৯৬ টাকা
আসামি সাবেক দুই জিএমসহ ১৮ কর্মকর্তা, বাদ পড়া পক্ষ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানসমূহ,
মামলাকারী দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক),
প্রশ্ন ঠিকাদারদের দায় কেন বাদ?

প্রকৃত জবাবদিহি না এলে আস্থা ফিরবে নাঃ

‘পর্দা কেলেঙ্কারি’ শুধু একটি প্রশাসনিক দুর্নীতির ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খাতে দায়মুক্তির সংস্কৃতির প্রতিফলন।
যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদার—উভয়ের বিরুদ্ধে সমানভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের কেলেঙ্কারি থামবে না।

আমরা ভুলে গেলে চলবে না—রেলওয়ে শুধু লোহা আর ট্র্যাক নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক শিরা-উপশিরা। এখানে অপচয় মানে রাষ্ট্রের রক্তক্ষরণ।

এখন সময় এসেছে, “দায়ী কারা?” সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার—কেবল কর্মকর্তা নয়, ঠিকাদার, প্রভাবশালী, অনুমোদনকারী—সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনাই হবে প্রকৃত ন্যায়বিচারের সূচনা।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article