Wednesday, November 19, 2025

অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিকরণ প্রক্রিয়া তরান্বিত করা: রেল প্রশাসনে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নতুন দিগন্ত

Must read

” মনিরুজ্জামান মনির”

১. প্রেক্ষাপট: প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার নতুন সূচনা

২৮ অক্টোবর ২০২৫ — রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালা হয়তো বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনের ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা হয়ে উঠবে।
কর্মশালার শিরোনাম— “অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিকরণ প্রক্রিয়া তরান্বিত করা ও অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের অংশীজনের সমন্বয়ে কর্মশালা।”

এই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মো: ফাহিমুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক জনাব মো: আফজাল হোসেন।
তাদের উপস্থিতি ও বক্তব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে—
বাংলাদেশ রেলওয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহি এখন “ফাইলের নোটে” সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি “কার্যকর পদক্ষেপে” রূপ নিতে চলেছে।

রেলওয়ে বাংলাদেশের জাতীয় অবকাঠামোর এক ঐতিহ্যবাহী ও আবেগপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিহীনতা, অডিট আপত্তির পাহাড় এবং প্রশাসনিক স্থবিরতা এই প্রতিষ্ঠানকে ভারাক্রান্ত করেছে।
তাই আজকের এই কর্মশালা কেবল একটি মিটিং নয়—এটি একটি প্রতিশ্রুতির সূচনা, যেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং প্রশাসনিক সততার পুনর্জন্ম ঘটতে পারে।

২. অডিট আপত্তি: একটি নীরব প্রশাসনিক সংকট

বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখানে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রতিনিয়ত বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু এই বিপুল আর্থিক কর্মকাণ্ডের ভেতরে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা “অডিট আপত্তি”গুলো যেন এক একটি অদৃশ্য গলায় ফাঁস।

অডিট আপত্তি মানে মূলত সেই সমস্ত আর্থিক অসঙ্গতি, নথিভুক্ত ভুল, অনুমোদনবিহীন ব্যয়, বা অনিয়ম যেগুলো সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনায় প্রশ্ন তোলে।
কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি দপ্তরগুলোর বাস্তবতায় “অডিট আপত্তি” অনেক সময় কেবল একটি ফাইলবন্দি ভয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

রেলওয়ের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি আরও গভীর।
অডিট আপত্তিগুলো অনেক সময় বছরের পর বছর নিষ্পত্তি না হয়ে পড়ে থাকে—
যেখানে কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প শেষ হয়েছে, এমনকি অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা অবসর নিয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন।
ফলে এই অমীমাংসিত আপত্তিগুলো হয়ে দাঁড়ায় এক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতীক।

প্রশ্ন হচ্ছে—
কেন রেলওয়ে, একটি এত পুরনো এবং অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান, এই সহজ প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে এত কঠিন করে তুলেছে?

উত্তরটি লুকিয়ে আছে অদক্ষতা, ভীতি এবং প্রশাসনিক দূরত্বে।

৩. সমস্যার মূল: ভাঙা সমন্বয় ও প্রশাসনিক বিভাজন

বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক প্রশাসনিকভাবে অত্যন্ত জটিল।
রেলওয়ে হলো একটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা, যার ওপর নির্ভর করে দেশের চলাচল ও পরিবহন ব্যবস্থা।
অন্যদিকে, রেলপথ মন্ত্রণালয় হলো নীতিনির্ধারক ও তদারকি সংস্থা।

কিন্তু বাস্তবে এই দুই স্তরের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক সময় একটি নথি মন্ত্রণালয় থেকে সদর দপ্তরে পৌঁছাতে সপ্তাহ লেগে যায়—আর একটি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিতে লেগে যায় বছর।

অডিট আপত্তির নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন—
১. রেলওয়ে হিসাব শাখার নথি,
২. প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যাখ্যা,
৩. নিরীক্ষা মহাপরিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ,
৪. এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন।

এই চার স্তরের মধ্যে যদি একটি মাত্র স্তরে জটিলতা তৈরি হয়, পুরো প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে।
ফলে, অডিট আপত্তি জমতে থাকে, কর্মকর্তারা ভয় পায়, নতুন প্রকল্পে অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হয়, এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি নিজেই।

৪. আর্থিক জবাবদিহি ও রাষ্ট্রীয় আস্থার প্রশ্ন

অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি রাষ্ট্রের আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন।
একটি প্রতিষ্ঠান যদি বছরের পর বছর তার হিসাবের অসঙ্গতি নিষ্পত্তি না করতে পারে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারি তদারকি সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী বা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আস্থা ক্ষুণ্ন হয়।

রেলওয়ের অনেক প্রকল্পে দেখা যায়—বিদেশি ঋণ বা অনুদানের শর্তে বলা থাকে যে, পূর্ববর্তী অর্থবছরের অডিট নিষ্পত্তি না হলে নতুন অর্থ ছাড় করা যাবে না।
এ অবস্থায় প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, লোকবল বেতন পায় না, এবং জনসেবা ব্যাহত হয়।

অডিট নিষ্পত্তি দ্রুত হলে শুধু অর্থনীতির গতি বাড়ে না—
বরং এটি পুরো প্রশাসনে একটি বার্তা দেয়:
রাষ্ট্রীয় সম্পদে জবাবদিহি ও সততার কোনও বিকল্প নেই।

৫. রেলওয়ে সংস্কারের মূল চাবিকাঠি: “অডিট সংস্কৃতি”র আধুনিকায়ন

আজকের কর্মশালাটি মূলত “অডিট সংস্কৃতি”র আধুনিকায়নের প্রথম ধাপ।
বাংলাদেশে এখনও অনেক দপ্তরে অডিট আপত্তি মোকাবিলা হয় প্রতিরক্ষামূলক মানসিকতায়।
যেন এটি এক ধরনের “দোষারোপ পর্ব”।

কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে অডিটকে দেখা হয় “পরিবর্তনের আয়না” হিসেবে—
যেখানে ভুলগুলোকে ধরা হয় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, এবং অডিট রিপোর্টকে ব্যবহার করা হয় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার টুল হিসেবে।

রেলওয়ের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন এই মানসিক পরিবর্তন।
অডিট আপত্তি মানে শাস্তি নয়, বরং শুদ্ধি।
অডিট মানে আঙুল তোলা নয়, বরং ভবিষ্যৎকে মজবুত করা।

এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারলেই রেলওয়ে তার প্রশাসনিক সংস্কারকে কার্যকর করতে পারবে।

৬. প্রশাসনিক সাহস ও নেতৃত্বের গুরুত্ব

রেলওয়ের ইতিহাসে আমরা বারবার দেখেছি—
নিরীক্ষা, অভিযোগ, কিংবা তদন্তের মুখে প্রশাসন চুপ থেকেছে।
ফলে অপরাধী বেঁচে গেছে, আর সৎ কর্মচারী ভয়ে পিছু হটেছে।

অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে হলে প্রয়োজন প্রশাসনিক সাহস।
সচিব জনাব ফাহিমুল ইসলাম ও মহাপরিচালক জনাব আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে এই সাহসের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
তারা উভয়েই জানেন—এই আপত্তি নিষ্পত্তি শুধু কাগজের কাজ নয়, এটি একটি নৈতিক সংস্কার আন্দোলন।

যদি এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি পুরো সরকারি খাতের জন্য এক দৃষ্টান্ত হবে।
কারণ, একটি সচিব ও একটি মহাপরিচালক যখন একসাথে প্রশাসনিক স্বচ্ছতার পক্ষে দাঁড়ান, তখন পরিবর্তন আসবেই।

৭. বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির অবস্থান ও প্রত্যাশা

বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ের প্রশাসনিক ও নীতিগত সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে।
আমাদের অবস্থান সবসময় স্পষ্ট—
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায়ভিত্তিক প্রশাসন ছাড়া রেলওয়ের পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়।

রেলওয়ের অডিট আপত্তি শুধু কাগজের সংখ্যা নয়; এর ভেতরে লুকিয়ে আছে হাজারো কর্মচারীর বঞ্চনা, ভুল সিদ্ধান্তের শিকার প্রকল্প, এবং অনিয়মের জালে আটকে থাকা সৎ কর্মকর্তাদের কষ্ট।
আমরা চাই এই কর্মশালার ফলাফল হোক বাস্তবায়িত নীতিমালা—
যেখানে অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে,
প্রতিটি আপত্তির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনোনীত করা হবে,
এবং নিয়মিতভাবে নিষ্পত্তির অগ্রগতি প্রকাশ করা হবে।

রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি রেল প্রশাসনের পাশে থাকবে,
কিন্তু অদক্ষতা ও দুর্নীতির পক্ষে নয়—
আমরা থাকব স্বচ্ছতা, ন্যায় ও জবাবদিহির পক্ষে।

৮. ভবিষ্যতের রোডম্যাপ: কীভাবে অডিট প্রক্রিয়া দ্রুততর করা যায়

অডিট নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হলে কিছু কাঠামোগত পদক্ষেপ এখনই নেওয়া জরুরি—
১. অডিট ট্র্যাকিং সিস্টেম:
একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যেখানে প্রতিটি আপত্তির অবস্থা (Pending, Under Review, Settled) রিয়েল টাইমে দেখা যাবে।
২. জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অডিট সেল:
কেন্দ্রীয় ফাইলে নির্ভর না করে প্রতিটি বিভাগীয় কার্যালয়ে ছোট অডিট নিষ্পত্তি ইউনিট গঠন করতে হবে।
৩. নিয়মিত প্রশিক্ষণ:
রেলওয়ের হিসাব কর্মকর্তাদের জন্য অডিট ও হিসাব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আধুনিক প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে।
৪. নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থা:
জটিল অডিট আপত্তির ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন তদন্ত টিম গঠন করতে হবে, যাতে প্রভাবমুক্তভাবে নিষ্পত্তি হয়।
৫. অডিট নিষ্পত্তির সময়সীমা:
প্রতিটি আপত্তি ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা দিতে হবে এবং বিলম্বের কারণ লিখিতভাবে জানাতে হবে।
৬. মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের যৌথ মনিটরিং কমিটি:
সচিব ও মহাপরিচালকের যৌথ সভাপতিত্বে মাসিক অগ্রগতি সভা আয়োজন করতে হবে।

দেরিতে হলেও সঠিক পথে যাত্রাঃ

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগ অনেক দেরিতে এলেও, এটি সঠিক পথে একটি সাহসী পদক্ষেপ।
অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরবে না—
ফিরে আসবে রেলওয়ের প্রতি জনআস্থা, কর্মচারীদের আত্মবিশ্বাস, এবং সরকারের প্রশাসনিক ভাবমূর্তি।

এই উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর—
রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা, এবং প্রযুক্তিগত বাস্তবায়ন।

স্বচ্ছতার পথে রেলওয়ের নতুন যাত্রাঃ

অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি মানে শুধু অতীতের ভুল মুছে ফেলা নয়;
এটি ভবিষ্যতের সঠিক পথে যাত্রার সূচনা।

রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের এই যৌথ কর্মশালা দেখিয়েছে যে—
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নিজেদের ভিতরকার অন্ধকারের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।
এটি কেবল প্রশাসনিক নয়, নৈতিক সাহসের প্রকাশ।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং প্রত্যাশা করে—
এটি যেন কেবল কর্মশালা বা বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব ফলাফলে রূপ নেয়।
রেলওয়ের প্রতিটি টাকার হিসাব হোক স্বচ্ছ,
প্রতিটি কর্মকর্তা হোক জবাবদিহির আওতায়,
এবং প্রতিটি অডিট আপত্তি হোক প্রশাসনিক পরিশুদ্ধির প্রতীক।

কারণ—
যে রাষ্ট্র নিজের হিসাব ঠিক রাখতে পারে, সেই রাষ্ট্রই ভবিষ্যৎকে সঠিকভাবে নির্মাণ করতে পারে।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article