কক্সবাজার এক্সপ্রেসের টিকিট, সে এক বিরাট ইতিহাস

0
162
কক্সবাজার শহরতলির ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ার ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন।

২০ বছর আগে প্রথম গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় প্রচার-প্রচারণার ডামাডোল আর ইউটিউবে প্রতিদিন অসংখ্য ভিডিও আপলোড হতে দেখে মনে সাধ জেগেছিল বিশ্ববিখ্যাত সমুদ্রসৈকতকে ফিরে দেখার। অনলাইনে কক্সবাজার এক্সপ্রেসের টিকিট করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম, তা রীতিমতো ভয়ংকর।

টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে সব টিকিট হাওয়া হয়ে গেছে অবিশ্বাস্যভাবে! অগত্যা কী আর করা; কক্সবাজারকে ফিরে দেখার খায়েশ পূরণ করতে ভিন্ন প্রচেষ্টায় টিকিট ম্যানেজ করার পথে নামতে হলো। এ দেশে যা দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়, তা ভিন্ন পথেই পাওয়া যায়। টিকিট কীভাবে পেলাম, তা বিস্তারিত না বলে প্রয়াত নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের একটি জনপ্রিয় নাটকের সংলাপের ভাষায় বলতে হয়, ‘সে এক বিরাট ইতিহাস।’

ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন হয়ে যাওয়া-আসার অভিজ্ঞতা কেমন, তা যাত্রী বা পর্যটকেরা ভালো বলতে পারবেন। কমলাপুর স্টেশনের বাইরে যানজট ও লোকজনের অনিয়ন্ত্রিত ভিড় আর বিশৃঙ্খল ট্রেন–ব্যবস্থার কারণে নিজের আসন খুঁজতেও অনেক ঘাম ঝরাতে হবে।

কেননা, ট্রেনের বগিগুলো ধারাবাহিক বা শৃঙ্খলিতভাবে না থাকায় এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে যাত্রা শুরুর আগেই ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়। কমলাপুর স্টেশন ও কক্সবাজার রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ফ্লোর মসৃণ না হয়ে এবড়োখেবড়ো হওয়ায় পর্যটকদের লাগেজ বা ট্রলি বহন করা বেশ কষ্টকর; সেই সঙ্গে ঢাকায় কুলিদের উটকো ঝামেলা তো রয়েছেই।

বুঝতে বাকি রইল না, ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি চলাচলকারী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ও সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের তুলনায় কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীসেবায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তা না হলে যাত্রা শুরুর দুই ঘণ্টা পর যাত্রীদের জন্য সতর্কতামূলক নির্দেশনা প্রচার করতে হয়, যখন যাত্রীরা গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকেন। তার চেয়েও বিরক্তিকর ছিল দিবাগত রাত দুইটায় টিকিট চেক করতে আসা, যা আসন গ্রহণের সময়ই সম্পন্ন করা যায়।

রাত গভীর হতে থাকলেও নিদ্রাগমনের উপায় ছিল না। কিছু যাত্রীর অহেতুক হইচই আর কিছুক্ষণ পরপর মগজ ধোলাই করা বিকট এক শব্দের কারণে বিরক্তির শেষ ছিল না। ৬৯৫ টাকার নন-এসি ও ১ হাজার ৩২৫ টাকার এসি চেয়ার কোচের আসনগুলো আকারে যে অবস্থা, তাতে একটু স্বাস্থ্যবান হলে বসতে হবে অস্বস্তিকরভাবে।

অনেকক্ষণ পর সেই বিকট শব্দের রহস্য বোঝা গেল। প্রতিটি আসনের নিচে লাগানো পাদানি ঘড়ির কাঁটার মতো অনবরত ওঠানো-নামানোর কারণে যাত্রীদের জন্য ছিল চরম এক অস্বস্তিকর অবস্থা। পর্যটক বা যাত্রীদের চলার পথে সচেতন হতে হবে, যাত্রাপথে এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হবে, যাতে অন্যদের বিরক্তির কারণ না হয়।

ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় রাত্রিকালীন ভ্রমণ হওয়ায় বাইরের কিছু দেখা না গেলেও কক্সবাজার থেকে ফিরে আসার সময় বাইরের দৃশ্য দেখে বোঝা যায়, অনেক কিছুই করা হয়েছে, তবে সবকিছুই যেন অর্ধনির্মিত বা অসমাপ্ত। খোদ কক্সবাজার স্টেশনে গিয়ে বোঝা যায়, অনেক কিছুই অসমাপ্ত।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ভান্ডারে থাকা ব্রিটিশ মডেলের স্টেশনের পাশে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশনের ভেতরে সর্বাধুনিক চলন্ত সিঁড়িসহ আধুনিক অনেক কিছুই চোখে পড়েছে, তবে সবকিছু যেন অসমাপ্ত। চোখে পড়বে স্টেশনের সঙ্গেই কাঁচা রাস্তার দৃশ্য। ট্রেনের অনেক কিছুই আধুনিক হওয়ায় এর ব্যবহার নিয়ে যাত্রীদেরও সচেতন হওয়ার দরকার রয়েছে; বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে।

উড়োজাহাজের মতো আধুনিক বায়োটয়লেট সংযোজন করায় নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবহারবিধি অনুসরণ করা প্রয়োজন যাত্রীদের। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যাত্রীদের চরম উদাসীনতায় নোংরা টয়লেট ব্যবহার করা তো দূরের কথা, দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া অনেক কষ্টকর।

যাহোক, রাতের ট্রেনে বা বাসে গিয়ে সকালে কক্সবাজারে পৌঁছে গেলেও রুম পেতে অপেক্ষা করতে হবে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত। হোটেলের চেকআউট সময় ১১টা হলেও পর্যটকেরা রুম ছাড়তে অনেক বেশি সময় নিয়ে থাকেন, যা নতুন আগত পর্যটকদের জন্য চরম বিরক্তির কারণ হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, আগে থেকে হোটেল বুকিং না করে গেলে আরও কঠিন অবস্থায় পড়তে হতে পারে রুমের জন্য।

রুম পেতে বিলম্ব হলে অলস সময় না কাটিয়ে আশপাশের হোটেল-রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা শেষে সমুদ্রসৈকত দেখে আসা যায়। রুম পাওয়ার পর লাঞ্চ শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে সূর্যাস্ত দেখার জন্য আবার সমুদ্রসৈকতে যেতে পারেন। চাইলে কলাতলীর কিছু হোটেলের রুমের বারান্দায় বসে থেকে সমুদ্র উপভোগ করতে পারবেন। রাতে-দিনে যেকোনো সময় লাবণী বিচ, সুগন্ধা বিচসহ আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়াতে পারেন স্থানীয় টমটম গাড়িতে করে, যাতে একসঙ্গে পাঁচ থেকে ছয়জন বসা যায়।

কক্সবাজার রেলস্টেশন থেকে সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি হোটেল-মোটেলে পৌঁছাতে টমটম গাড়িতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ হতে পারে। গাড়িচালকদের চাওয়া একটু বেশি হতে পারে, তাই দরদাম ঠিক করে নেওয়াই ভালো। উন্নত মানের প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাসসহ সব ধরনের গাড়ি পাবেন যাতায়াতের জন্য। তবে খরচ সাশ্রয়ের কথা বিবেচনা করলে স্থানীয় টমটম ব্যবহারে ফায়দা বেশি পাবেন।

আশপাশের এলাকায় ঘোরাঘুরি করার জন্য আগে দরদাম ঠিক করে নিলে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় পাওয়া যাবে। এই বেড়ানোর ফাঁকে লাঞ্চ বা ডিনার সেরে নিতে পারেন আশপাশের হোটেল-রেস্টুরেন্টে। স্ট্রিট ফুড থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারের দোকান মিলে যাবে কলাতলী, লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্টে। সৈকতে বসে বা শুয়ে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখতে হলে চেয়ার কাম বিছানা পেয়ে যাবেন প্রতি ঘণ্টার জন্য ৬০ টাকা খরচে।

পরিবেশবাদীদের প্রচারণা বা ভূমিকার কারণে সৈকত এখন বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখা যায়। স্থানীয় হকারদেরও এ ব্যাপারে বেশ সচেষ্ট দেখা গেছে। অতীতে সমুদ্রসৈকতে যেভাবে প্লাস্টিক বর্জ্যসহ নানা রকম ময়লা দেখা গেছে, তা এবার তেমন চোখে পড়েনি নিয়োগকৃত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সদা সতর্কতায়। সমুদ্র ঘেঁষে তৈরি করা মেরিন ড্রাইভের রাস্তা দিয়ে যেতে পারেন ইনানী বিচ দেখে পাটুয়ারটেক পর্যন্ত লংড্রাইভে।

কক্সবাজার প্রশাসনের উদ্যোগে নভেম্বর মাস থেকে চালু করা হয়েছে ছাদখোলা ডাবল ডেকার বাসের মাধ্যমে কলাতলী থেকে পাটুয়ারটেক সৈকত যাওয়ার ব্যবস্থা। বাসের খোলা ছাদের নিচে আসনপ্রতি ৭০০ টাকা এবং বাসের ভেতরে আসনপ্রতি টিকিটের মূল্য ৬০০ টাকা। টমটম গাড়িতে দরদাম ঠিক করে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টার জন্য চুক্তিতে গেলে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় যেতে পারেন ৫ থেকে ৬ জন একসঙ্গে। একটু আরাম-আয়েশে ছয় থেকে সাতজন মিলে ছোট মাইক্রোবাসে লাগতে পারে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা।

এই যাত্রাপথে দেখে যেতে পারেন সুগন্ধা পয়েন্ট, লাবণী পয়েন্ট, দরিয়ানগর, নাজিরারটেক, হিমছড়ি ঝরনা, ইনানী বিচ হয়ে পাটুয়ারটেকে বিচে। ড্রাই ফিশ বা শুঁটকিপ্রেমী হলে আসা-যাওয়ার পথে নিজের জন্য বা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের জন্য ভালো মানের শুঁটকি কিনতে পারেন নাজিরারটেক আড়ত থেকে।

ইনানী বিচের আশপাশে লাঞ্চ বা ডিনারের জন্য পাবেন অসংখ্য হোটেল-রেস্টুরেন্ট। যেখানে দেশিসহ পছন্দ অনুযায়ী সব ধরনের খাবার পাবেন জনপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। সঙ্গেই আছে পাঁচ তারকা হোটেল রয়েল টিউলিপ ও পালংকির মতো বড় রেস্টুরেন্ট। রাতের বেলায় প্রায় সব রেস্টুরেন্টের সামনে তাজা সামুদ্রিক মাছের জমজমাট আয়োজন শুরু হয়। পর্যটকেরা চাইলে নিজের পছন্দের নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছের সঙ্গে অক্টোপাস, স্কুইড, কাঁকড়াসহ নানান কিছু দিয়ে দল বেঁধে বারবিকিউ আয়োজন করতে পারেন।

প্রিয়জন বা নিজের জন্য বার্মিজ আচারসহ নানা ধরনের স্যান্ডেল–পোশাক পাবেন বড় বড় মার্কেট ও শপিং সেন্টারে। যেখানেই যান, দোকানিদের হাঁকডাক অনেক বেশি হবে, তাই জিনিসপত্র যাচাই-বাছাই করে ভেবেচিন্তে দরদাম ঠিক করে নেওয়াই উচিত। ২০ বছর আগের দেখা কক্সবাজারের চেয়ে এখন অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। বড় বড় সুউচ্চ ভবন আর মার্কেটের আলো–ঝলমলে রাস্তায় রাতের বেলায় রাজধানীর মতো যানজটের অভিজ্ঞতাও সঙ্গী হতে পারে।

প্রাইভেট কারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং কলাতলী এলাকায় বাসস্টেশন হওয়ার কারণে রাস্তায় এলোমেলোভাবে বাস রেখে দেওয়ার কারণেই এই যানজট। সব মিলিয়ে লাবণী পয়েন্ট বেশ গোছানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছে। গড়ে উঠেছে পাঁচ তারকা মানের অনেক হোটেল—আল গনি, কল্লোল হোটেলের কাসুন্দি, শালিকসহ অনেক ভালো মানের রেস্টুরেন্ট।

দেখা যাবে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। তবে দেশীয় পর্যটকের তুলনায় বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। তাই সরকারিভাবে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার পরিকল্পনায় কক্সবাজারকে নিয়ে আরও বেশি নজর দিতে হবে পর্যটনশিল্পের আয়ের বিবেচনায়।

সূত্র: প্রথম আলো

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here