রেল সংযোগের একটি প্রকল্পে প্রথমে অনুমোদন দিয়ে পরে আবার তা বাতিল করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। অর্থায়ন নিয়ে চীন ও ভারতের সঙ্গে মতভেদের পর এটি বাতিল করা হয়েছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আবার সেই প্রকল্পের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। সরকারের দুই উপদেষ্টা এরইমধ্যে এই প্রকল্প নিয়ে বৈঠকও করেছেন।
‘বাংলাদেশ রেলওয়ের আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পটি কেন গ্রহণ করা হয়েছিল, কেনই বা প্রকল্পটি বাতিল করা হলো––এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন দুই উপদেষ্টা। প্রকল্পটি গ্রহণে কোনও অসঙ্গতি ছিল কিনা, কোনও অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা সেসব বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছেন তারা। প্রকল্পটি জনকল্যাণকর কিনা বা জনকল্যাণকর হলে বাতিল হওয়া এই প্রকল্পটি আবারও বাস্তবায়ন করা যায় কিনা, এসব বিষয়েও দুই উপদেষ্টা আলাপ-আলোচনা করেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, রবিবার (৬ অক্টোবর) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের দুই সচিবকে নিয়ে বৈঠক করেন। দুপুর ১২টায় শুরু হয়ে দুই উপদেষ্টার এই বৈঠক চলে বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত।
প্রায় দুই ঘণ্টার এই বৈঠক সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে দুই মন্ত্রণালয়ের কেউই কোনও মন্তব্য করেননি। এমনকি এই বৈঠক সম্পর্কে দুই উপদেষ্টার দৈনন্দিন কার্যক্রমেও কিছু উল্লেখ ছিল না।
চীনা অর্থায়নে জিটুজি পদ্ধতিতে (সরকার থেকে সরকার) ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। প্রকল্পে ৬৬ দশমিক ১৬ শতাংশ অর্থায়ন করার কথা ছিল চীন সরকারের। এমনকি ঠিকাদার নির্বাচনসহ প্রায় সব প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছিল। চীনের রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যৌথ সমঝোতা স্মারকও সই হয়।
সব রকম দরকষাকষি সম্পন্ন করে ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পটিতে অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরবর্তী সময়ে ‘অত্যধিক ব্যয়বহুল’ মনে হলে প্রকল্পের খরচ কমানোর নির্দেশনা আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি চীনের নিযুক্ত করা ঠিকাদার। দর চূড়ান্তকরণের পর তা কমানোর নির্দেশ পেয়ে বেঁকে বসে চীনা কোম্পানি। পরে এ প্রকল্প থেকে সরে যায় তারা।
পরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভারতের অর্থায়ন পাওয়ার চেষ্টা করে শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের (ইরকন) মাধ্যমে কাজ পাওয়া সাপেক্ষে অর্থায়ন নিশ্চিত করার প্রস্তাবে বাংলাদেশ সম্মত হয়নি। ফলে প্রকল্প বাঁচানোর এই চেষ্টাও বিফলে যায়। কোনোভাবেই অর্থায়ন জোগাড় না হওয়ায় প্রকল্পটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপি থেকে বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ আরও সহজ করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছিল এই প্রকল্পটি। এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের জুনে। কিন্তু নির্ধারণ করা দর থেকে ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা (২০.৮ শতাংশ) কমে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতে বলেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এ অনুশাসনের পর ‘ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ বিষয়ক কমিটি’ গঠন করা হয়। খরচ কমানোর জন্য প্রস্তাব তৈরি করে এ সংক্রান্ত কমিটি।
কমিটির প্রতিবেদনে দর নির্ধারণের জন্য চলমান অন্য প্রকল্পের আইটেমের দরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মতামত চাইলে তারা বেশ কয়েকটি যুক্তি দেখিয়ে প্রকল্পের মূল্য পুনর্নির্ধারণে একমত পোষণ না করে জবাব পাঠায়। সেখানে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিজিপি) অনুমোদিত দরমূল্য বহাল রাখার কথা বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব নিয়ে চিঠি চালাচালি শেষে প্রকল্প থেকে সরে যায় চীনা প্রতিষ্ঠানটি।
আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ২৩৯ দশমিক ১৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ ডুলেগেজে রূপান্তরে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২ হাজার ৭৫০ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মাটির কাজে ৩৪৬ কোটি ২৮ লাখ, ট্র্যাকের কাজে ১৯২ কোটি ৫৭ লাখ, সিগন্যাল ও টেলিকম খাতে ২১ কোটি ৬১ লাখ, সেতু ও কালভার্ট খাতে ১৪৬ কোটি ৪৬ লাখ, স্টেশন ও বিল্ডিং খাতে ২০ কোটি ৩৩ লাখ এবং প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে ১ হাজার ৩৮২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু রাজি হয়নি ঠিকাদার চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশন-সিআরবিসি।
উল্লেখ্য, আখাউড়া-কুলাউড়া-ছাতক রেলপথ হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের অধীন একটি মিটারগেজ রেলপথ। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া জংশন থেকে হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ জংশন হয়ে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া জংশন এবং সেখান থেকে সিলেট জেলার সিলেট স্টেশন হয়ে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক বাজার স্টেশন পর্যন্ত বিস্তৃত।
অন্তর্বর্তী সরকার কেন এই প্রকল্প নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে––জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, এটি (রবিবারের বৈঠক) আমাদের নিজস্ব প্ল্যানিং মিটিং ছিল। সেখানে আখাউড়া-সিলেট রেললাইন প্রকল্পটি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করেছি। জানার চেষ্টা করছি কেন প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পাওয়ার পরও বাতিল করতে হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রকল্পটি আবারও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আরও আলোচনা-পর্যালোচনা প্রয়োজন।