রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা-টঙ্গী অংশ ডুয়াল গেজ। এ অংশ মিটার গেজ ও ব্রড গেজ—দুই ধরনের ট্রেন চলাচলে সক্ষম। বিপরীতে টঙ্গী-আখাউড়া অংশের রেলপথটি মিটার গেজ, যেখানে শুধু মিটার গেজ ট্রেন চলতে পারে। অন্যদিকে আখাউড়া-লাকসাম অংশ ডুয়াল গেজ। লাকসাম থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দোহাজারী পর্যন্ত অংশটি আবার মিটার গেজ। আর দোহাজারী-কক্সবাজার অংশ ডুয়াল গেজ। গেজ ভিন্নতার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে চলাচল করতে পারে শুধু মিটার গেজ ট্রেন। সক্ষমতা থাকলেও অব্যবহৃত থাকছে আখাউড়া-লাকসাম ও দোহাজারী-কক্সবাজার অংশের ডুয়াল গেজ রেলপথ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের পুরো অংশ ব্রড গেজ ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পৃথক তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিপুল ব্যয়ের এসব প্রকল্প এগিয়ে নেবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারাও।
যদিও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটি আরো আগেই ব্রড গেজে উন্নীত করা উচিত ছিল বলে মনে করছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা প্রায়ই দেখি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে পণ্যবাহী ট্রেনগুলো লাইনচ্যুত হয়। গতি কমিয়ে চলার পরও লাইনচ্যুতির ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না। লাইনচ্যুতির একমাত্র কারণ মিটার গেজ রেলপথ। পাশাপাশি মিটার গেজ রেলপথের প্রডাক্টিভিটি কম, যা এ করিডোরের উপযোগী নয়।’
দেশের ব্যস্ততম রেলপথটি ব্রড গেজে উন্নীতকরণের কাজ নিয়ে যখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তখন একই পথে মাত্র ছয় বছর আগে বাস্তবায়ন করা দুটি প্রকল্প নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। প্রকল্প দুটির মাধ্যমে ২০১৮ সালে টঙ্গী-ভৈরববাজার ও লাকসাম-চিনকি আস্তানা অংশ মিটার গেজ ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।
অধ্যাপক সামছুল হক মনে করছেন এ দুই প্রকল্পের মাধ্যমে রেলপথটির সিংহভাগ অংশ ব্রড বা ডুয়াল গেজে রূপান্তর করে ফেলার একটা ভালো সুযোগ ছিল। তিনি বলেন, ‘তখন কম খরচে ডুয়াল গেজ করে ফেলা সম্ভব ছিল। এটার জন্য দরকার ছিল দূরদর্শী পরিকল্পনা। ছয় বছর আগে মিটার গেজ রেলপথ বানিয়ে এখন ডুয়াল গেজের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর মানে ছয় বছর আগে যে বিনিয়োগ হলো তার পুরোটাই অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।’
বাংলাদেশে রেলপথের গেজ ভিন্নতার কারণে দুই ধরনের ট্রেন চলাচল করে। ব্রড গেজ রেলপথে যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য ডিজাইন স্পিড ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। বিপরীতে মিটার গেজ রেলপথে ডিজাইন স্পিড ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। পণ্যবাহী ট্রেনগুলোও মিটার গেজ রেলপথের চেয়ে ব্রড গেজে বেশি গতি নিয়ে চলতে পারে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ডুয়াল গেজ ট্রেন চলাচলের উপযোগী হলে এ পথে যাতায়াতে সময় কম লাগবে। ফলে অধিকসংখ্যক যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের সুযোগ তৈরি হবে।
রেলপথটি ব্রড গেজ ট্রেন চলাচলের উপযোগী করতে হলে তিন অংশ নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এর একটি টঙ্গী-আখাউড়া। এজন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার হয়ে আখাউড়া পর্যন্ত ‘ডুয়াল গেজ ডাবল ট্র্যাক রূপান্তর’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা বিদেশী ঋণ হিসেবে চায় রেলওয়ে। প্রকল্পটির জন্য এখনো অর্থায়নকারী চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডোরের উন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা থাকায় সংস্থাটির কাছ থেকেই ঋণগ্রহণ যৌক্তিক হবে বলে মনে করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডুয়াল গেজ ডাবল ট্র্যাক রূপান্তর প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে রেলওয়ে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির কাজ চলমান। এ প্রকল্পের আওতায় ১৩১ দশমিক ২ কিলোমিটার রেলপথ মিটার গেজ থেকে ডুয়াল গেজে রূপান্তর করা হবে। চট্টগ্রামে ব্রড গেজ কোচের জন্য ডিপো ও লোকোমোটিভ শেডসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে ২০০টি ব্রড গেজ কোচও কেনা হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, প্রকল্পটির একটি প্রাক-উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) প্রকল্পটির অনুকূলে ৬০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। অবশিষ্ট অর্থের জোগানের আশ্বাস দিয়েছে এডিবি।
এ দুই অংশ বাস্তবায়িত হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ব্রড গেজ ট্রেন চলতে পারবে। অন্যদিকে কক্সবাজার পর্যন্ত ব্রড গেজ ট্রেন পরিচালনা করতে হলে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত অংশটি ডুয়াল গেজে রূপান্তর করতে হবে। এ লক্ষ্যে রেলওয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।
রেলওয়ের সমীক্ষার তথ্য বলছে, এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ডিজাইন স্পিড বাড়বে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত সময় কম লাগবে। যাত্রীবাহী ট্রেনের শিডিউল মেনে চলার হার ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। নতুন লাইনে কনটেইনার ট্রেনগুলো মেইল এক্সপ্রেস ট্রেনের সমান গতিতে চলতে পারবে। এতে কনটেইনার পরিবহনেও সময় কমে আসবে। একইভাবে টঙ্গী-আখাউড়া রেলপথও ট্রেন চলাচলের সময় কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে। ২০২৫ সালে শুরু করে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম আমাদের ব্যস্ততম রেলপথগুলোর একটি। ডুয়াল গেজে রূপান্তরের ক্ষেত্রে এখনো দুটি মিসিং লিংক রেলপথটিতে রয়ে গেছে। দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে মিসিং লিংকগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাস্তবায়নের পর রেল করিডোরটি আরো বেশি ট্রেন চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠবে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়া কক্সবাজার পর্যন্ত ব্রড গেজ ট্রেন পরিচালনার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম-দোহাজারীর মধ্যকার মিসিং লিংক ঠিক করতে পৃথক আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।’
কার্টেসিঃ বনিক বার্তা