মো. মাহবুবুল হক
ভারতবর্ষজুড়ে রেলপথের প্রায় পুরোটাই স্থাপন করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। উদ্দেশ্য ছিল এ দেশ থেকে আহরিত সামগ্রী ছয়টি বন্দরে পৌঁছানো। তারপর জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর হচ্ছে, ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ে ১০০ পয়সা আয় করতে ২৫৮ পয়সা ব্যয় করেছে।
১৫৮ পয়সা লোকসান গুনেছে। পাশের দেশ ভারতে ৯৮ পয়সা খরচ করে দুই পয়সা লাভ পায়। ওদের রেল বিভাগ লাভ করে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রেলের দুর্নীতি, টিকিট কালোবাজারি, অনিয়ম, অপরিকল্পিত প্রকল্প নেওয়া হয় বলে বিভাগটির এমন অবস্থা।
এসব অনৈতিক কাজ থেকে বেরিয়ে এসে বিভাগটির আধুনিকায়ন হলে পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে বলে তাঁরা মনে করেন। নিরন্তর চেষ্টা চলছে। সম্ভবত বছর দশেক আগে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথ বেশ কয়েকটি খণ্ড খণ্ড রুটে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল।
স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। এক সকালে দেখা গেল, ট্রেন যে প্ল্যাটফরম থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা, সেখানে নেই। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে যাত্রীদের সুবিধার জন্য চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছিল। কিছুদিন চলার পর সেগুলো বিকল হয়ে পড়ে। আর খোঁজখবর নেই।
বিভাগের এক তরুণ প্রকৌশলী উৎসাহভরে বিকল ট্রেন ঘুরে ঘুরে দেখেন। বাজার থেকে ক্ষুদ্র একখানা যন্ত্রাংশ কিনে ট্রেনটিতে জুড়ে দেন। ট্রেন চলতে শুরু করে। পরীক্ষামূলকভাবেও সফল হয়েছিল। জাদুর মতো কাজ করেছে। সে সময়ে দেশীয় প্রজ্ঞা, মেধা ব্যবহারে অবহেলা-অনীহা-অবজ্ঞা করার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে অকেজো ডেমুগুলো কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। লম্বা চলন্ত ট্রেনটি বলা নেই, কওয়া নেই, কয়েকটি বগি এক পাশে হেলে পড়ে গেল। কতজন যাত্রী নিহত হলো, কতজন আহত হলো, কতজন বগির নিচে চাপা পড়ে রইল, তার কোনো হিসাব থাকে না। মানুষের যেমন বয়স হলে রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন, তেমনি যন্ত্রপাতি, যানবাহনেরও রক্ষণাবেক্ষণ লাগে। রেলের ট্র্যাক দুর্বল হলে তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। না হলে ট্রেনের হেলে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। ছোটবেলায় দেখতাম, জনা কয়েক লোক হাতে টানা চার চাকাওয়ালা প্ল্যাটফরমটি রেলের ট্র্যাকের ওপর দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা ট্র্যাক পরীক্ষা করতে নেমেছে। এখন দেখা যায় না।
স্কুলে পড়ি। ষাটের দশক। বাবার কাছে বায়না ধরেছিলাম দেশে নিয়ে যেতে। যাত্রাপথ : বাসা থেকে ফুলবাড়িয়া স্টেশন, ঝকঝকে তকতকে ট্রেনের ইন্টারক্লাস কামরায় উঠে বসা, উপবিভাগীয় শহরে অবতরণ, মামাবাড়িতে রাত্রিযাপন, ভোরবেলায় রিকশাযোগে গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা। সে কী আনন্দ! ষাটের দশকের ঘটনা আর আজকে এমন ভ্রমণের মধ্যে পার্থক্য নজরে পড়ে কি? হ্যাঁ, পড়ে। সে সময়ে ছিল আনন্দ আর আজ আতঙ্ক। কখন যে প্রাণপাখি উড়ে যাবে!
রেলওয়ের হেলে পড়ার রোগ দূরই হচ্ছে না। কাগজের শিরোনাম হয়েছে ‘কমলাপুরে ট্রেন লাইনচ্যুত ও যাত্রীদের ভোগান্তি’। আরেকটি শিরোনাম ‘বিপুল ব্যয়ে স্টেশন বিলাস’। প্রতিবেদনের এক জায়গায় বলা হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রক্ষণাবেক্ষণসহ খরচের হিসাব ৩০ লাখ টাকার বেশি। অথচ বছরে আয় হয় ৯ লাখ টাকা। স্টেশনটি গাজীপুরের। কয়েক মাস আগে রেল বিভাগ কক্সবাজারে একটি বিলাসবহুল স্টেশন নির্মাণ করে। এটির সঙ্গে চট্টগ্রাম রেল সংযোগ করা হয়েছিল। কয়েক মাস ব্যবহারের পর রেললাইনটি বালুর মধ্যে বসে যায়। যোগাযোগ আজ পর্যন্ত বন্ধ।
বিভাগটি না পেরেছ নিরাপদ যাত্রীসেবা দিতে, না পেরেছে আর্থিক উত্কর্ষ বজায় রাখতে। সাদা হাতি বললেও কম বলা হবে।
লেখক :
মো. মাহবুবুল হক
সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও পরিচালক
প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন