রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকেশেডে ১০ বছর ধরে পুশিংয়ের কাজ করছেন ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার) গোলাম শাহরিয়ার। কিন্তু তিনি কোনোদিন ট্রেন চালাননি। দপ্তরে দিনের পর দিন কাটছে তার। এদিকে ট্রেন না চালিয়েই মাইলেজ তোলেন তিনি।
রেলওয়ে চট্টগ্রামে শাহরিয়ারের মতো এমন ট্রেনচালক ও সহকারী ট্রেনচালকসহ রয়েছে ২০ থেক ৩০ জন। তারা বিভিন্ন দপ্তরে ‘তদবিরের মাধ্যমে’ বিভিন্ন পদে কাজ করে যাচ্ছেন। ট্রেন না চালিয়ে প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা ভুয়া মাইলেজ দেখিয়ে টাকা তুলছেন। অথচ চালক সংকটের কারণে পূর্বাঞ্চলে ট্রেন পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে রানিং স্টাফদের অফিসে কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে পূর্বাঞ্চলের রেল কর্মকর্তা জানান, রানিং স্টাফদের অফিসে কাজ করা অবৈধ নয়। জনবল সংকটের কারণে হয়তো বিভিন্ন দপ্তরে অনেকে কাজ করেন।
রেলওয়ে চট্টগ্রামের সিআরবি ও পাহাড়তলীতে ১০ জন চালক, ১০ জন সহকারী চালক ও ৬ জন সাব ট্রেনচালক বিভিন্ন পদে কাজ করছেন। প্রতিমাসে বেতনের সঙ্গে অবৈধভাবে ৫০-৬০ হাজার টাকা মাইলেজ তুলে নিচ্ছেন। তেমনই একজন ট্রেনচালক সুমন রঞ্জন দাশ। পাহাড়তলী বিভাগীয় যান্ত্রিক বিভাগে (ডিএমই অফিস) ১৮ বছর ধরে করণিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখান অফিসে গড়ে তুলেছিলেন ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট। নিজেও বেনামে ঠিকাদারি করতেন। গত ৯ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের আদেশের পর তাকে সরানো হয় বিভাগীয় প্রকৌশল অফিস থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, অন্যের নামে লাইসেন্স নিয়ে ঠিকাদারি করেন তিনি। বিভাগীয় অফিসের কেনাকাটা ও মালামাল সরবরাহ করে কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান এলাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট।
এমনকি সুমন রঞ্জন তার দুর্নীতিতে সহায়তার জন্য আপন বোনকে খালাসি পদ থেকে প্রকৌশল বিভাগে নিয়ে আসেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুমন রঞ্জন দাশ বলেন, ‘আমার পেছনে লোক লেগেছে। তারা এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াচ্ছে। আমি বিভাগীয় প্রকৌশল বিভাগে কাজ করেছি, তবে কোনো দুর্নীতি করিনি৷ আমার কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নেই। চাইলে যে কেউ তদন্ত করে দেখতে পারে৷’
এছাড়া ট্রেনচালক মো. নজরুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান সিআরবি পাওয়ার কট্রোল (সিপিএনএল) অফিসে কাজ করেন গত ২০ বছর ধরে। ট্রেনচালক সুমন চক্রবর্তীও আছেন এখানে।
পাহাড়তলী লোকেশেডে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এসএম শাহেদ আলী। খোরশেদ আলম ও মো. হানিফ আছেন শেডম্যান হিসেবে।
মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ ট্রেনিং সেন্টারে ও অঞ্জন কান্তি বিশ্রাঙ্গী পাহাড়তলী পাওয়ার কন্ট্রোলে (পিএনএল) কাজ করেন।
সহকারী চালকদের (এএলএম) মধ্যে পাহাড়তলী পাওয়ার কন্ট্রোল অফিসে আছেন শাহেদুল ইসলাম, শুভ রায়। পাহাড়তলী লোকোশেড আমতলা অফিসে করণিক হিসেবে কাজ করেন রেহানা আবেদিন, কুলসুমা আকতার, খুরশীদা আকতার, সালমা বেগম, উম্মে সালমা সিদ্দিকা, সাজেদা খানম, কোহিনূর আকতার। শাহাদাত হোসেন খন্দকার চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে জুনিয়র লোকো ইন্সপেক্টর (জেএলআই) হিসেবে কাজ করেন।
সহকারী ট্রেনচালক মনিরুল ইসলাম চট্টগ্রাম রেলওয়ে জেনারেল বুকিং ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন। স্টেশনে নির্ধারিত জেনারেল বুকিং ক্লার্ক থাকার পরও তিনি ওখানে কাজ করেন।
সিআরবি কন্ট্রোল অফিসে কাজ করেন মো. ইকবাল চৌধুরী ও আহসান হাবিব। হাবিব উল্লাহ বেলালী, জাহেদুল ইসলাম চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে জেএলআই হিসেবে কাজ করেন। এর মধ্যে কন্ট্রোল অফিস মো. মিজানুর রহমান ২০১৮ সালে এএলএম থেকে এসএলএম হন।
এসব ট্রেনচালক ও সহকারী চালকদের ট্রেন চালানোর দায়িত্বে থাকার কথা হলেও তারা তদবিরের মাধ্যমে পড়ে আছেন বিভিন্ন দপ্তরে৷ এর মধ্যে অনেকেই ভুয়া মাইলেজের টাকা তুলে নিচ্ছেন।
পাহাড়তলী লোকোশেডে পুশিংয়ের কাজ করা ট্রেনচালক গোলাম শাহরিয়ার বলেন, ‘আমি মাইলেজ তুলি। এখানে ট্রেন শান্টিংয়ের কাজ করি। আমার জুনিয়র দিয়েও কাজ করাই। তবে আমি অফিসে চাকরি করি না৷’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘রানিং স্টাফদের অফিসে কাজ করা অবৈধ নয়। জনবল সংকটের কারণে হয়তো বিভিন্ন দপ্তরে অনেকে কাজ করেন।’
৯ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সচিব মহোদয়ের আদেশ নিয়ে কাজ করছি। ভুয়া মাইলেজ তুলে নেওয়া ও অফিসে রানিং স্টাফের কাজের বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্মকর্তা দেখবে৷’