Monday, April 21, 2025

ট্রেনে কমেছে মালামাল পরিবহন, ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে কুলিদের দুর্দিন

Must read

রেলস্টেশনে লাল পোশাক পরা ব্যক্তিদের আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, লাল পোশাক পরা এসব ব্যক্তিই ট্রেনে আসা মালামাল ওঠানামা করেন। গতকাল সোমবার সকাল থেকে দুপুর ১২টা নাগাদ কোনো মালামাল ওঠানামা করাতে পারেননি আজহার মিয়া নামের এক কুলি। কাঁধে গামছা, হাঁটছেন প্ল্যাটফর্ম–জুড়ে। জামাটিও বিভিন্ন স্থানে ছিঁড়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মের পদচারী–সেতুতে দাঁড়িয়ে দেখেন পুরো স্টেশন। কুলিদের জীবন-জীবিকায় দুর্দিনের চিত্র আজহার মিয়ার শরীরেই ভেসে ওঠে।

দুই দশক আগেও ট্রেন এলে মালামাল ওঠানামায় ব্যস্ত সময় পার করতেন আজহারের মতো অন্তত ৬০ জন কুলি। কিন্তু এখন তা অতীত। ট্রেন ও রেলপথে মালামাল পরিবহন কমতে থাকায় কুলিরাও পেশা বদল করছেন।

অন্তত ৩০ বছর ধরে ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশনে কুলির কাজ করছেন মো. আজহার মিয়া। তাঁর বাড়ি নগরের কালীবাড়ি গুদারাঘাট এলাকায়। আগে চট্টগ্রামে সবজি বিক্রি করতেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে সংসার ছিল। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে সজীব মিয়া ভাঙারির ব্যবসা করে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা থাকেন। সংসারের ঝামেলার কারণে ময়মনসিংহে এসে কুলির কাজ শুরু করেন আজহার মিয়া।

আজহার মিয়া জানান, লোকাল ট্রেনগুলোতে আগে অনেক ধরনের মালামাল পরিবহন করা হতো। পুরো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মালামালের জন্য চলাচল করা যেত না। কিন্তু সড়কপথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায়, লোকাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং বিভিন্ন স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালামাল পরিবহন কমে গেছে। এখন একদম কাজ নেই। স্টেশনে ১০-১২ জনের মতো কুলি আছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যা কামাই করি, বাজারে গেলে দেহি জিনিসের দাম আরও বেশি। অনেক কষ্টে দিন পার করছি। এই বয়সে অন্য পেশায় যাব, সে সুযোগও নেই। প্রথমে যে টাকা পাইতাম, তা দিয়ে ভালোভাবে চলা যাইত, এখন যা পাই তা দিয়ে চলে না। করোনার সময় থাইকা আমাদের কষ্ট বাড়ছে।’

রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু হয় দেশের অন্যতম পুরোনো ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশনের। এই জংশন হয়ে বর্তমানে জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, জারিয়া, চট্টগ্রামগামী ২৪ জোড়া ট্রেন চলাচল করে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় ময়মনসিংহে ট্রেনকেন্দ্রিক বাণিজ্য ছিল রমরমা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসত কৃষিপণ্য। পাশাপাশি ভারী মালামালও পরিবহন করা হতো; কিন্তু লোকাল ট্রেন বন্ধ ও বিভিন্ন স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাটা পড়েছে রেলকেন্দ্রিক পণ্য পরিবহন। বেশির ভাগ সময়ই বেকার বসে থাকেন কুলিরা। দুই দশক আগেও ৫০-৬০ জন কুলি কাজ করতেন। মালামাল আসা কমে যাওয়ায় অনেক কুলি পেশা বদল করেছেন, বেছে নিয়েছেন সহজলভ্য পেশা; কিন্তু আদি পেশা আঁকড়ে এখন কিছু কুলি চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকেন ট্রেন আসবে, মালামাল ওঠানামা করাবেন এই অপেক্ষায়।

বেলা দেড়টার দিকে নেত্রকোনার জারিয়া থেকে ঢাকাগামী বলাকা এক্সপ্রেস ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালে ট্রেনে মালামাল তুলতে ছোটেন আজহার মিয়া, মঞ্জু মিয়া ও মোহাম্মদ হাসান নামের তিনজন কুলি। মজুরি পান মাত্র ৮০ টাকা। প্রায় ৪০ বছর ধরে কুলির কাজ করছেন মঞ্জু মিয়া। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মুজাটিয়া গ্রামে। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক তিনি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে চা দোকানি এবং আরেক ছেলে কর্মহীন। মঞ্জু মিয়া বলেন, ‘আগে ট্রেনে মালামাল বেশি আসত, বেশি টাকা কামাইতে পারতাম; কিন্তু অহন কামকাজ নাই, লোকাল ট্রেন বন্ধ তাই সংসার নিয়ে চলা কঠিন। অহন ৪০০-৫০০ টেহা কামানিই কষ্ট। দিনে দেড়-দুই শ টাকা খরচ অইয়া যায়। না পাইরা এই পেশায় আছি আরকি।’

৬৮ বছর বয়সী মো. ইদ্রিস আলী ওরফে ইদু ভাই ছোটবেলা থেকেই কুলির কাজ করেন। নগরের ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় তাঁর বাসা। তাঁর বাবা জমশেদ আলীও কুলির কাজ করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের ভার টানতে শিশুকাল থেকেই স্টেশনে কাজ শুরু করেন। বয়সের কারণে এখন মালামাল টানাটানি করতে পারেন না। রেলপথে কমে গেছে মালামাল পরিবহনও। দৈনিক যা আয় হয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে তা দিয়ে জীবন বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। ইদ্রিস আলী বলেন, ‘লোকাল ট্রেনগুলো বন্ধ, সে কারণে কাম কম। নিজেও চোখে কম দেহি। বোঝা মাথায় নিয়ে চলাচলও করতে পারিনি। কোনো মতন ডাইল-ভাত খাইয়া বাইচ্চা আছি। বুড়া বয়সে অন্য কোনো পেশায় যাওনেরও জায়গা নাই।’

ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট এস এম নাজমুল হক খান বলেন, লোকাল ট্রেনগুলোতে আগের মতো পণ্য পরিবহন এখন হয় না। সে কারণে কুলিদের কাজ কমে গেছে।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article