রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেটে অবস্থিত শহীদ আনোয়ারা উদ্যানে স্টেশন প্লাজা নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল)। তবে স্থানীয় ও পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। আগামী মার্চের মধ্যেই জনসাধারণের জন্য পার্কটি উন্মুক্ত করে দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের জায়গাটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন। এর রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে জায়গাটি মেট্রোরেলের প্রকল্প অফিস ও নির্মাণ উপকরণ রাখার কাজে ব্যবহার করে আসছে ডিএমটিসিএল। কথা ছিল, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষে সেটি ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু ২০২৩ সালে মেট্রোরেল বাণিজ্যিক যাত্রার পর ডিএমটিসিএল থেকে জানানো হয়েছিল, পার্কের জায়গায় তৈরি করা হবে স্টেশন প্লাজা। আর সেখানে থাকবে বিভিন্ন দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কফিশপ, বিনোদন কেন্দ্রসহ শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা। ডিএমটিসিএল এজন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরে একটি চিঠিও দিয়েছিল। মেট্রোরেলের পরিচালন ব্যয় মেটানোর জন্য ফার্মগেটের পাশাপাশি আগারগাঁও, উত্তরা উত্তর ও কমলাপুরেও স্টেশন প্লাজা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
উদ্যানের জায়গায় মেট্রোর স্টেশন প্লাজা নির্মাণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন নগরবিদ ও পরিবেশ সংগঠকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগের সিদ্ধান্ত থেকে এবার সরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে জানাতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জনস্বার্থে শহীদ আনোয়ারা উদ্যানে মেট্রো প্লাজা করার সিদ্ধান্ত আমরা বাতিল করেছি। এটি আগে যেমন পার্ক ছিল, এখনো পার্ক হিসেবেই থাকবে। আগামী মার্চে এটা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।’
ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে উদ্যানটি মেট্রোরেলের নির্মাণসামগ্রী রাখার কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। কথা ছিল রেলের কাজ শেষ হলে সেটিকে আগের রূপে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এখন দেরিতে হলেও পার্কটি আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। আনোয়ারা উদ্যান রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন পরিবেশ ও জলবায়ু কর্মী নয়ন সরকার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সড়ক উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, ২৬ মার্চের মধ্যে পার্কটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন না দেখা পর্যন্ত আমাদের দাবি ও আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অতীতেও আমরা অনেক কথার ফুলঝুরি শুনেছি। কিন্তু বাস্তবায়ন দেখিনি। যেদিন আনোয়ারা উদ্যানে সুস্থ পরিবেশে হাঁটতে পারব, প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারব সেদিনই আমাদের আন্দোলন পূর্ণতা পাবে।’
মেট্রোরেল নির্মাণকাজে উদ্যানটির ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নগরবিদরা। কেননা খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এটি সম্পূর্ণ নিষেধ। আইনটিতে বলা হয়েছে, মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান, জলাধারের জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন, অন্য কোনোভাবে ব্যবহার বা ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা কিংবা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। তাছাড়া ঢাকা বিশদ উন্নয়ন পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-৩৫ অনুযায়ীও ফার্মগেট শহীদ আনোয়ারা উদ্যান ঢাকা উপ-অঞ্চল ২৬-এর অন্তর্ভুক্ত, যেখানে এটিকে উন্মুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকার মতো দূষণে শীর্ষ শহরটির পার্ক নষ্ট করে প্লাজা নির্মাণের পরিকল্পনা যারা নিয়েছিলেন তারা আদতে সুস্থ ছিলেন না। অনেক দেরিতে হলেও সরকার সঠিক বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। এখন পার্কের পরিবেশ-পুনরুদ্ধার করাই হবে সরকারের প্রধান কাজ।’
জানা গেছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের বিষয়ে সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তর ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে উদ্যানটি ফিরিয়ে দিতে ডিএমটিসিএলকে নির্দেশ দেয়া হয়। তবে উদ্যান ফিরিয়ে দেয়া হলেও যাত্রী ওঠানামার জন্য একটি অংশ নিজেদের কাছেই রাখছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। শহীদ আনোয়ারা উদ্যান নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করছে বলেও জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, ‘পরিবেশ উপদেষ্টা, সড়ক উপদেষ্টাসহ আমরা গণপূর্তের সঙ্গে বসেছি। অলরেডি সিদ্ধান্ত পেয়ে গেছি। জনস্বার্থে আনোয়ারা পার্কে স্টেশন প্লাজা করার সিদ্ধান্ত থেকে আমরা সরে এসেছি। ওই পার্কের মালিকানা আমাদের না। সেটি ব্যবহারের জন্য নিয়েছিলাম। তবে পার্কের একেবারে ছোট্ট একটা অংশ আমাদের লাগবে, ড্রপ অ্যান্ড পিকআপের জন্য। একেবারেই ছোট্ট একটা অংশ। ওই অংশ রেখে বাকিটা আমরা ছেড়ে দেব। মার্চ-এপ্রিলের দিকেই এটা ছেড়ে দেব। একটা অংশ এরই মধ্যেই পরিষ্কার করে দিয়েছি। বাকিটাও ছেড়ে দেব। পার্ক নিয়ে একটা ডিটেইল্ড ডিজাইন করছে গণপূর্ত।’