নিজস্ব সংবাদদাতা :
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সদর দপ্তর সিআরবিতে রেলের টেন্ডার আহ্বান মানেই ছিল যুবলীগ ক্যাডার হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও ছাত্রলীগ ক্যাডার সাইফুল আলম লিমন বাহিনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি, সংঘর্ষ কিংবা গুলিবিনিময়। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই বাহিনীর সংঘর্ষে ঘটেছিল জোড়া খুনের ঘটনা। বাবর বা লিমনের গ্রিন সিগন্যাল না পেলে টেন্ডার বক্সের কাছে যাওয়ার সাহস পেতেন না কোনো ঠিকাদার। কেউ কেউ চেষ্টা করলেও বাবর-লিমন বাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক। ঠিকাদার এমনকি রেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার ঘটনাও কম নয়। পরিবর্তিত সময়ে বাবর-লিমন পালিয়ে থাকলেও সৃষ্টি হয় আরও কয়েকটি গ্রুপ। তবে শেষ পর্যন্ত ভয়কে জয় করে সিআরবিতে বাণিজ্য বিভাগে দুটি টেন্ডারের কার্যক্রম হয়েছে স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলকভাবে
ঠিকাদাররা জানিয়েছেন, শিডিউল কিনতে যেমন কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি, তেমনি জমা দিতেও ভয়-আতঙ্ক নিয়ে বক্সের কাছে যেতে হয়নি। তারা বলেন, বিগত ১৫ বছর তারা এভাবে সরাসরি এসে টেন্ডার জমা দিতে পারেননি। বাধাহীনভাবে শিডিউল ক্রয় ও জমা দিতে পারায় তারা খুশি।
জানা গেছে, দুটি প্যাকেজে তিনটি ট্রেনের অন বোর্ড সার্ভিসের টেন্ডার আহ্বান করা হয় গত ১২ মার্চ। এক দফা সময় বাড়িয়ে গত বুধবার ছিল শিডিউল ক্রয় ও জমার শেষ দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার খোলা হয় দরপত্র। এ সময় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী, রেলওয়ে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও সেনাবাহিনী টহলে ছিল।
টেন্ডার আহ্বানকারী রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) মাহবুবুর রহমান জানান, চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী তূর্ণানিশিতা এক্সপ্রেস ও মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস ট্রেন এবং ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটে চলাচলকারী হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনের অনবোর্ড সার্ভিসের উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। উভয় প্যাকেজের ২০টি করে শিডিউল বিক্রি হলেও জমা পড়েছে ১৬টি করে। গতকাল সবার সামনে দরপত্র খোলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তূর্ণানিশিতা ট্রেনের সর্বনিম্ন দরদাতা স্বপ্নীল অ্যাসোসিয়েট ও হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনের মাহী কনসোর্টিয়াম সর্বনিম্ন দরদাতা। তিনি বলেন, কেবল সর্বনিম্ন দরদাতা হলেই হবে না; কারিগরি ও অন্যান্য বিষয় ঠিক থাকলেই কার্যাদেশ পাবে।
সিসিএম রাহবুবুর রহমান বলেন, অতীতে কীভাবে হয়েছে সেটা আমি জানি না। আমি দায়িত্বে আসার পর থেকে উন্মুক্ত দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক করার চেষ্টা করছি। বাইরে কিছু হয়েছে কি না সেটা আমরা জানি না; তবে আমরা প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিয়েছি। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব ও সেনাবাহিনী টহল দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে টেন্ডার সম্পন্ন হওয়ায় অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটেনি।
জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সিআরবি ও পাহাড়তলীতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক গ্রুপ। তারা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের কথার বাইরে গিয়ে টেন্ডার জমা না দেওয়ার জন্য হুমকি ও কয়েকজন কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেছে তারা। দীর্ঘ ১৫ বছর রেলওয়ের টেন্ডার, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেছে রেলওয়ে শ্রমিক লীগ। ৫ আগস্টের পর তাদের স্থান নিয়েছে রেলওয়ে শ্রমিক দল ও বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ।
টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে বেঙ্গল ফাইভস্টার সিকিউরিটি লিমিটেডের পরিচালক আকরাম হোসেন মিনার বলেন, গত ১৫ বছর আমরা এখানে টেন্ডার জমা দিতে আসতে পারিনি। এমনকি শিডিউল করতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের কথার বাইরে গিয়ে কেউ শিডিউল ক্রয় করলে সেটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। শিডিউল জমা দিতে এসে অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই। সবাই অংশ নিতে পারছে; এতে রেল এবং ঠিকাদার উভয়ে লাভবান হবেন।
উল্লেখ্য, অনবোর্ড সার্ভিসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, টয়লেটে সাবান, তোয়ালে, টিস্যু, ফাস্ট এইড বক্স, বদনা, ঝুড়ি, ঝাড়ু, বালতিসহ মোট ২৪ ধরনের সেবা দিয়ে থাকেন ঠিকাদাররা। তার বিনিময়ে প্রতি মাসে রেলওয়ে টেন্ডারের কার্যাদেশ অনুযায়ী অর্থ নিয়ে থাকেন।