ইসমাইলআলী: রেলের উন্নয়নে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে সরকার। এক যুগের ব্যবধানে এ বরাদ্দ বেড়ে ২০ গুণ হয়েছে। কিন্তু রেলের সেবায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। বরং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর ঝুলছে। এতে বাড়ছে নির্মাণব্যয়। ফলে প্রচুর অর্থ অপচয় করা হচ্ছে। সঙ্গে ভুল পরিকল্পনা তো রয়েছেই। এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে রেলওয়ে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’-এর বৈঠকে এসব প্রশ্ন ওঠে। বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রেলপথ নির্মাণ ও কোচ কেনার ব্যয়ের তুলনামূলক হিসাব চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রেল সেবার মানোন্নয়নের তথ্যও চেয়েছে কমিটি।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ভারতের চেয়ে বেশি। এমনকি চীনের হাইস্পিড রেলপথের চেয়েও বাংলাদেশে সাধারণ রেলপথ নির্মাণব্যয় বেশি। এর অন্যতম উদাহরণ পদ্মা রেল সংযোগ (ঢাকা-ভাঙ্গা-যশোর রেলপথ) নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পে ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। তবে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪০ হাজার ৪০১ কোটি টাকায়। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ২৩৯ কোটি ছয় লাখ টাকা।
একইভাবে দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ নির্মাণ ব্যয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার ৩০৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এরপরও গত এক দশকে রেলপথটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। আবার খুলনা-মংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭২১ কোটি ৩৯ লাখ। তবে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে চার হাজার ৩২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা।
এদিকে আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ নির্মাণ ও জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প দুটিতে চার হাজার ৮৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে। তবে এ ব্যয় কমিয়ে প্রকল্প সংশোধনের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
শুধু রেলপথ নির্মাণই নয়, কোচ কেনায়ও অনেক বেশি ব্যয় করছে রেলওয়ে। এর মধ্যে অন্যতম ২০০ ব্রডগেজ কোচ কেনা প্রকল্প। এগুলোর মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ৩১০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যদিও সম্ভাব্যতা যাচাইকালে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় ৩৯ শতাংশ বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে।
আবার ২০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ কেনার আরেক প্রকল্পে ১৭৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়েছিল। তবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কম মূল্য প্রস্তাব করায় এ অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। এজন্য প্রকল্প ব্যয় উল্টো কমানো হবে। এভাবেই সরকারি অর্থের অপচয় করছে রেলওয়ে, যা নিয়ে শেয়ার বিজে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
রেলের এ ধরনের অপচয়ের বিষয়গুলো অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উঠে এসেছে বলে সূত্র জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে কমিটি। এর মধ্যে রয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রতি কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ ব্যয়, রেলের বগি ক্রয়সহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদির একটি তুলনামূল চিত্র আগামী এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে পেশ করতে হবে।
বৈঠকে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালে রেলের বাজেট ছিল ৬০০ কোটি টাকা। বর্তমানে তা ১২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ায় অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা/ক্যাপাসিটি কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে পেশ করতে হবে। এছাড়া রেলের চলমান ৩৯টি প্রকল্পের মধ্যে ২০টির বাস্তবায়ন ৫০ শতাংশের নিচে। সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে কী কী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা বা ভূমি অধিগ্রহণে কোনো জটিলতা থাকলে তা প্রতিবেদন আকারে পেশ করতে হবে।
এদিকে ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়কে ট্রেনের আন্ডারপাস দিয়ে পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে দুটি হাইকিউব কনটেইনার পরিবহন সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রতিটি কনটেইনার পরিবহনে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে আগামী এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন পেশ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বৈঠকে এর বাইরেও ছয় দফা সুপারিশ করে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এর মধ্যে কভিড-১৯-এর কারণে যেসব প্রকল্পের কাজ কম হয়েছে, তা নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অর্থ ও সময় সাশ্রয়ের জন্য বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে জমি অধিগ্রহণ/জমি ভরাটের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, শ্রীমঙ্গলে উদ্ধারকৃত জমিতে সীমানা প্রাচীর দেয়া, অডিট আপত্তি দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করা উল্লেখযোগ্য।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার শেয়ার বিজকে বলেন, অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ব্যয়ের তুলনামূলক হিসাব নিরূপণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করা হবে, যারা এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন প্রণয়ন করবে।
উল্লেখ্য, সরকারের বাজেট বরাদ্দ ও তার ব্যবহার নিয়ে পর্যালোচনা করে ‘অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’। ১০ সংসদ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির সভাপতি মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ।