Wednesday, November 19, 2025

সহিংস অবরোধ নয়, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই গণতন্ত্রের শক্তি।ভৈরব জেলা দাবির আন্দোলন ও নাগরিক দায়িত্বের নতুন প্রশ্ন।

Must read

“মনিরুজ্জামান মনির”

ভৈরবকে জেলা ঘোষণার দাবিতে আজকে “ভৈরব জেলা বাস্তবায়ন সমন্বয় কমিটি” সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ দাবির পক্ষে এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি গণতান্ত্রিক দাবি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—সরকারি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আদায়ের জন্য কেন সাধারণ মানুষের চলাচলের পথ অবরুদ্ধ করতে হবে? সরকারই তো জেলা ঘোষণার ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা, সড়ক-রেল বা নৌপথ নয়। তাহলে এই অবরোধ কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত কার ক্ষতি করছে—সরকারের, না সাধারণ জনগণের?

সাম্প্রতিক সময়ে ভৈরবে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় অন্তত ২০ জন যাত্রী আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিলেন। ট্রেনটি রেলপথ অবরোধের মধ্যে পড়েছিল। এই ভয়াবহ ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আন্দোলনের নামে সহিংসতা কখনোই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও মানবিক মূল্যবোধের ক্ষতি করে।

আন্দোলন গণতন্ত্রের প্রাণ, কিন্তু শৃঙ্খলাবিহীন আন্দোলন ধ্বংসাত্মকঃ

গণতন্ত্রে মতপ্রকাশ ও আন্দোলনের অধিকার সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত (বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ)। নাগরিকরা তাদের দাবি, ক্ষোভ বা প্রত্যাশা প্রকাশ করতে পারেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে—সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন বা স্মারকলিপির মাধ্যমে।
কিন্তু সেই অধিকার কখনোই অন্যের অধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ দেয় না। সংবিধান স্পষ্টভাবে বলে—জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা অন্যের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ডকে ‘অধিকার’ হিসেবে দাবি করা যায় না।

রেলপথ, সড়ক ও নৌপথ কেবল অবকাঠামো নয়—এগুলো দেশের অর্থনীতির রক্তধারা। এগুলো বন্ধ করে দেওয়া মানে কোটি মানুষের জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করা। একটি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স যদি অবরোধে আটকে থাকে, একটি শিশুর পরীক্ষা মিস হয়, বা একটি ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে একজন আহত হয়—তবে সেই আন্দোলনের নৈতিকতা হারিয়ে যায়।

কাদের উদ্দেশে অবরোধ, এবং এর ফল কার ঘাড়ে পড়ে?

ভৈরবকে জেলা করা হবে কি না—এটি একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, যার প্রস্তাবনা প্রণয়ন করে স্থানীয় প্রশাসন এবং চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অর্থাৎ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হচ্ছে সরকার, কোনো পরিবহন রুট নয়।
তাহলে রেল, সড়ক বা নৌপথ অবরোধ করে জনগণের কষ্ট সৃষ্টি করে কীভাবে সরকারের ওপর কার্যকর চাপ তৈরি করা সম্ভব? বরং এতে জনগণ সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আর আন্দোলনকারীরাই নৈতিক অবস্থান হারায়।

রাজনীতির ইতিহাসে দেখা যায়, সফল আন্দোলনগুলো সবসময়ই ‘লক্ষ্যনির্দিষ্ট’ ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন—সব ক্ষেত্রেই জনগণের অংশগ্রহণ ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, যেখানে সহিংসতা নয় বরং নেতৃত্বের প্রজ্ঞা প্রাধান্য পেয়েছিল।

সহিংস অবরোধের পরিণতি: প্রশাসনিক, আইনগত ও সামাজিক ক্ষয়ঃ

রেলপথে অবরোধ বা হামলার ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধের আওতায় মামলা হয়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৪১, ১৪৩, ১৪৬, ১৫২, ৩৩৩ ও ৪২৭ ধারায় জননিরাপত্তা বিঘ্ন, সরকারি সম্পত্তি ক্ষতি, সরকারি কর্মচারীকে বাধা প্রদান ইত্যাদির জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এইসব ঘটনায় শুধু আইন প্রয়োগ হয় না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক বিভাজনও তৈরি হয়। জনমনে ভয়, অবিশ্বাস এবং অনাস্থা জন্ম নেয়—যা স্থানীয় আন্দোলনের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।

একটি শান্তিপূর্ণ দাবিকে যদি সহিংসতা আচ্ছন্ন করে, তাহলে সরকার সেটিকে আর গণতান্ত্রিক দাবি হিসেবে বিবেচনা করে না। ফলে প্রশাসনিক আলোচনার দরজাও বন্ধ হয়ে যায়।

সঠিক পথ: নিয়মতান্ত্রিক, আইনি ও লক্ষ্যভিত্তিক আন্দোলনঃ

প্রশাসনিক বা নীতিগত সিদ্ধান্ত আদায়ের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো—সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে লক্ষ্য করে আন্দোলন গড়ে তোলা। অর্থাৎ, মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, জেলা প্রশাসন ও আদালতকে কেন্দ্র করে সচেতন, ধারাবাহিক ও সংগঠিত কর্মসূচি নেওয়া।

ভৈরববাসীর উচিত—

১. স্মারকলিপি প্রদান: জেলা ঘোষণার পক্ষে বিশদ যুক্তিসহ প্রশাসনিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরে লিখিত প্রস্তাব পাঠানো।

২. গণস্বাক্ষর অভিযান: নাগরিক ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সমর্থন সংগ্রহ করা।

৩. সভা-সমাবেশ ও গণসংলাপ: সুশীল সমাজ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে উন্মুক্ত সংলাপ আয়োজন করা।

৪. মিডিয়া কৌশল: সহিংসতা নয়, উন্নয়ন ও প্রশাসনিক যৌক্তিকতা তুলে ধরে সংবাদ প্রচার করা।

৫. সরকারি অফিস ও আদালত অবরোধ (প্রতীকী): যদি প্রয়োজন হয়, সীমিত সময়ের জন্য প্রতীকী কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে—যাতে সিদ্ধান্তগ্রহণকারী পর্যায়ে বার্তা পৌঁছে, কিন্তু জনদুর্ভোগ না হয়।

এইভাবে নিয়মতান্ত্রিক, লক্ষ্যনির্দিষ্ট ও অহিংস আন্দোলনই সরকারের বিবেচনায় বেশি প্রভাব ফেলে এবং সাধারণ জনগণের সহানুভূতি ধরে রাখে।

রেল জাতীয় সম্পদ, আন্দোলনের লক্ষ্য নয়ঃ

বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু একটি পরিবহন সংস্থা নয়—এটি জাতীয় ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক শিরা-উপশিরা। রেলের উন্নয়ন মানে দেশের আঞ্চলিক ভারসাম্য উন্নয়ন। ফলে রেলকে অবরোধ বা আক্রমণের টার্গেট বানানো শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়, এটি আত্মঘাতীও।
রেলপথে যাত্রীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে জনবিশ্বাস ক্ষয় হয়, যা সরকারের উন্নয়ন নীতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

অতএব, ভৈরব জেলা দাবির মতো ন্যায়সঙ্গত একটি আন্দোলনকে রেলের ক্ষতির মাধ্যমে প্রচার করা মানে নিজ দাবির বৈধতা খর্ব করা।

আন্দোলনের নতুন সংস্কৃতি গড়ার সময় এসেছেঃ

বাংলাদেশে এখন এমন এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সময় চলছে, যেখানে নাগরিক আন্দোলনের রূপান্তর জরুরি।
প্রয়োজন “আচরণভিত্তিক প্রতিবাদ সংস্কৃতি”, যেখানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে শক্তি হিসেবে দেখা হবে, সহিংসতাকে নয়।
যে আন্দোলন অন্যের অধিকারকে সম্মান করে, সেটিই দীর্ঘস্থায়ী হয়।
যে আন্দোলন জনগণের জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, সেটি নিজেই নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।

ভৈরববাসীর দাবি যদি সত্যিই প্রশাসনিকভাবে যুক্তিযুক্ত হয়, তবে সেটিকে শক্তিশালী করতে হবে প্রমাণ, গবেষণা, পরিসংখ্যান ও নাগরিক ঐক্যের মাধ্যমে—পাথর, আগুন বা অবরোধের মাধ্যমে নয়।

ভৈরবকে জেলা করা হোক—এ দাবি যুক্তিযুক্ত হতে পারে, কিন্তু সেই দাবি প্রতিষ্ঠার পথটি হতে হবে ন্যায্য, মানবিক ও আইনি কাঠামোসম্মত।
জনগণের কষ্ট, পরিবহন নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদকে উপেক্ষা করে কোনো আন্দোলনই স্থায়ী সফলতা আনতে পারে না।
আন্দোলনের শক্তি তার যুক্তিতে, তার নেতৃত্বে এবং তার নৈতিকতায়—অবরোধ বা সহিংসতায় নয়।

বাংলাদেশ এখন একটি পরিণত সমাজের দিকে যাচ্ছে, যেখানে গণতন্ত্রের মাপকাঠি শুধু ভোট নয়, বরং কীভাবে আমরা প্রতিবাদ করি—সেটিও গণতন্ত্রের পরিপক্বতার পরিমাপ।
সুতরাং, সহিংস অবরোধ নয়—নিয়মতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল আন্দোলনই হোক নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদের পথ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article