ছোট্ট একটা মুদিদোকান চালান আলমগীর হোসেন (৪০)। দোকানের কাছে নীলফামারী সদর উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের দারোয়ানী রেলগেট। এই রেলগেটে কোনো গেটম্যান নেই। তাই ট্রেনের হুইসেল বাজলে দৌঁড়ে তিনি ওই রেলগেটে ছুটে যান। বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে রেলগেটের দুই পাশে বাঁশ ফেলেন। তবে রেলে চাকরি করেন না আলমগীর। ওই কাজের জন্য পান না কোনো মজুরিও।
আলমগীর হোসেনের দোকান থেকে রেলগেটের দূরত্ব ২০০ গজ। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এ সময় তিনি দোকানে বসে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছিলেন। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই সব কাজ ফেলে তিনি দৌঁড়ে যান রেলগেটে। গলায় থাকা বাঁশি বাজাতে বাজাতে দুই দিকে বাঁশ ফেলে গেট বন্ধ করেন। ট্রেন চলে যাওয়ার পর বাঁশ তুলে পথচারীদের পথ ছেড়ে দেন।
আলমগীর হোসেন বলেন, ‘২৬ জানুয়ারি আমার চোখের সামনে একটি ইজিবাইক ওই গেট পারাপারের সময় ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে চার নারীশ্রমিক নিহত হন। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ইজিবাইক চালকসহ তিনজন। ওই ঘটনায় আমি মর্মাহত। অনেক ভেবেচিন্তে পরদিন আমার নিজের বাঁশ কেটে ওই গেট পাহারার দায়িত্ব নিয়েছি নিজ উদ্যোগেই।’
মুদিদোকানের পেছনে সোনারায় ইউনিয়নের গোলকশাহপাড়ায় এক শতাংশ খাসজমিতে বসবাস করেন আলমগীর। তার দুই ছেলে আমিনুল ইসলাম ও দিনার আলম এবার এসএসসি পাস করেছে। একমাত্র মেয়ে জান্নাতি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম গৃহিণী।
আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এই কাজ নেওয়ার পর আমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। এখন সবাই জানে ট্রেন আসার সময় হলে দুই পাশে বাঁশ ফেলা থাকবে। এটা না করলে মানুষ মনে করবে ট্রেন আসার সময় হয় নাই।’
আলমগীর হোসেনকে সময় মেনে রেলগেটে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ভোর ৫টায় আন্তনগর রূপসা, সকাল ৭টায় বরেন্দ্র, আটটায় খুলনা মেইল পার করার পর তিনি ভ্যান চালাতে যান। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিতুমীর আসে আর বেলা ৩টায় ফিরে যায়, বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে নীলসাগর আসে, আবার রাত ৯টার দিকে নীলসাগর ফিরে যায় এবং বরেন্দ্র আসে। ওই সময়ের মধ্যে তাঁকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হয়।
এক কিলোমিটার দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। হুইসেল শুনে আমি সেখানে যাই। অনেক সময় নির্দিষ্ট সময় থেকে আমি সেখানে অবস্থান নিই। কখনো ট্রেন দেরিতে এলে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়।
আলমগীর হোসেন, মুদিদোকানি, সোনারায় ইউনিয়ন, নীলফামারী সদর উপজেলা।
আলমগীর আরও বলেন, ‘এক কিলোমিটার দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। হুইসেল শুনে আমি সেখানে যাই। অনেক সময় নির্দিষ্ট সময় থেকে আমি সেখানে অবস্থান নিই। কখনো ট্রেন দেরিতে এলে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। এ জন্য ভ্যান নিয়ে বেশি দূরে যেতে পারি না। যে কারণে রুজিরোজগারও আগের তুলনায় কম হচ্ছে। তাতেও আমার কষ্ট হয় না। এলাকার লোকজন বলে, কাজটা নাকি ভালো, তারা উৎসাহ দেয়।’ এ সময় তিনি ওই রেলগেটে দ্রুত একজন গেটম্যান নিয়োগের জন্য রেল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।
এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নূরুল ইসলাম শাহ বলেন, এটি নিঃসন্দেহে একটি মানবিক কাজ। এলাকার অনেকের সামর্থ্য থাকলেও এগিয়ে আসেননি। তাঁর মতো নিম্ন আয়ের একজন মানুষ এগিয়ে এসে মানবিক একটি কাজের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহযোগিতার জন্য আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে ওই ব্যক্তিকে রেলগেটটিতে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। যেহেতু তিনি সামান্য আয়ের মানুষ, তাঁর পরিবার রয়েছে, এ জন্য তাঁকে সহযোগিতার জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে নিয়মিত সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে। নিয়মিত দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে এককালীন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়টিও চিন্তাভাবনার মধ্যে আছে।’
উৎস: প্রথম আলো