কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক করে ছুটে চলেছে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। আট বছরের শিশু আবির মা–বাবার সঙ্গে কুমিল্লা থেকে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম ফিরছে। মাঝপথে হঠাৎ কারও ছোড়া পাথর এসে পড়ল শিশু আবিরের মুখে। রক্তাক্ত হলো আবির। তিন–তিনটা কাঁচা দাঁত ভেঙে গেল। গত ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকার ঘটনা। আহা, মানুষের নিরাপত্তা সাড়ে তিন হাত মাটিতে কবরস্ত হয়ে গেছে। কোথায় নিরাপদ আমরা। ধারাবাহিকভাবে ঘটছে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ।
একবার ভাবুন, যাত্রাপথে যদি এসব পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, কেমন লাগে? চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারার ঘটনাটি দেশে নতুন নয়। দেশে নিরাপদ যাত্রার প্রধানতম মাধ্যম বাংলাদেশ রেলওয়ে। ট্রেনযাত্রা মানে আরামদায়ক ভ্রমণ। সড়কপথে বিনিয়োগ না করে রেলওয়ে খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করে ট্রেনযাত্রা নিরাপদ করা জরুরি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতিদিন ১৪ হাজারের বেশি ট্রেন নিরাপদে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রদেশে আসা–যাওয়া করে। এক প্রদেশ থেকে সকালে ট্রেনে উঠে অফিস শেষ করে ট্রেনেই নিরাপদে বাড়ি ফেরেন অনেক মানুষ।
রাজধানী এক্সপ্রেসে কলকাতা থেকে দিল্লি গিয়েছিলাম। চমৎকার আসনব্যবস্থা, ট্রেনের অভ্যন্তরে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা এবং ট্রেন ব্যবস্থাপনা এত সুন্দর, যে কেউ দেখে মুগ্ধ হবেন। আমাদের হাতে গোনা কয়েকটি আন্তনগর ট্রেন। তা–ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। নিরাপত্তা বা নিরাপদ শব্দ দুটি আমাদের অভিধানে আছে, বাস্তবে নেই। চট্টগ্রামে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা, তূর্ণা নিশীথায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসা–যাওয়া করেন দেশের প্রথম শ্রেণির মানুষ। নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা যদি হয় গোদের ওপর বিষফোড়া, তাহলে কেমন লাগে? ইদানীং সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করা। ছোড়া পাথরের আঘাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না সাধারণ জনগণ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তা, রেলওয়ে নিরাপত্তাকর্মীরাও রেহাই পাননি পাথর থেকে। শিশু থেকে শুরু করে তরুণ, তরুণী, বয়স্ক—কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। পাথর ছুড়ে মারার হটস্পট কিংবা পাথর নিক্ষেপের জায়গাগুলো এখনই চিহ্নিত করা জরুরি।
দেশের অনেক জায়গা আছে, যেখানে প্রায় সময় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায় কিছু বিপথগামী শিশু ও কিশোর গ্যাং, দুর্বৃত্ত, বখাটে, সুবিধাবঞ্চিত শিশু। ওদের কাছে হয়তো বিষয়টা ক্ষণিক আনন্দের। কিন্তু তারা জানে না, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ মানে একটি পরিবারের সারা জীবনের আক্ষেপ। ছুড়ে মারা পাথর কারও জন্য সারা জীবনের কান্নার। সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পারছি, চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট রেলক্রসিং, পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ড, ভাটিয়ারি, বাড়বকুণ্ড, কুমিল্লা, ফেনীর ফাজিলপুর, কমলদহ, নরসিংদী, জিনারদী, ঘোড়াশাল, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, আক্কেলপুর, উল্লাপাড়া, যমুনা সেতু, খুলনার ফুলতলা, বেনাপোল ইত্যাদি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে অহরহ।
৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র কৌশিক পাল শাটল ট্রেনে করে সন্ধ্যায় শহরে ফিরছিলেন। ২ নম্বর গেট রেলক্রসিং এলাকায় চলন্ত ট্রেনে টোকাইদের ছোড়া পাথরের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
গত ছয় বছরের ব্যবধানে দুই হাজারের বেশি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙেছে, বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে সুবর্ণ এক্সপ্রেসে বাড়ি যাচ্ছিলাম, কুমিল্লা-ফেনীর মাঝখানে জায়গাটার নাম মনে নেই। জানালার ফটক দিয়ে বিশাল সাইজের পাথর এসে পড়ে ট্রেনের এক যাত্রীর মাথায়। মাথা ফেটে গুরুতর আহত হন। খুব সম্ভবত ২০১৩ সালে ঈদের ছুটি শেষে চট্টগ্রাম থেকে ফিরছিলাম। ট্রেনের অন্য বগিতে ছিলেন প্রকৌশলী প্রীতি দাশ (২৪), বিয়ে হয়েছে মাত্র ১৭ মাস। ভাটিয়ারি এলাকায় চলন্ত ট্রেনে ছুড়ে মারা পাথরের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালে খুলনার বেনাপোল রোডে কমিউটার ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরের আঘাতে চলন্ত ট্রেনের পরিদর্শক বায়েজিদ মারাত্মকভাবে আঘাত পান। ৪১ দিন পর মৃত্যুর কাছে হার মানেন। ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বগিতেও ছোড়া হয় পাথর। দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান তিনি। সৈয়দপুরে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে এক ছোট শিশুর চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা বারবার হচ্ছে কিন্তু প্রতিকার নেই। কর্তৃপক্ষ দেখে দেখে তন্দ্রাবিলাস করছে। ২০২১ সালে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১১০ বারের বেশি। এ ঘটনায় প্রায় ২৯ জন আহত হয়। এ কাজ হয়তো অবুঝ শিশুদের জন্য ক্ষণিক আনন্দের কিন্তু অন্য একটি পরিবারের জন্য কান্নার এবং বিষাদেরও বটে। অনেকে খেলার চলে কে কয়টা জানালার ভেতর প্রবেশ করাতে পারে, এ প্রতিযোগিতায় নেমে ট্রেনের জানালায় পাথর ছুড়ে মারে।
পাথর ছোড়ার এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ওই এলাকায় সচেতনতামূলক বিভিন্ন ক্যাম্পিং, মাইকিং, বস্তি এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে মানববন্ধন, কাউন্সেলিং, স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম করা যেতে পারে। চিহ্নিত এলাকাগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা যেতে পারে। তার আগে রেললাইনের পাশের বস্তিবাসীকে পুনর্বাসন করা জরুরি। অনেক রাঘববোয়ালরা রেলওয়ের জমি গ্রাস করে নিয়েছে। সরকারি জমিগুলো উদ্ধারের বালাই নেই। অপরাধমূলক সেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতারা। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
পুলিশ প্রশাসন, বিশেষ করে রেলওয়ে পুলিশ এবং রেলওয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের আরও বিচক্ষণ ও সজাগ হওয়া জরুরি। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হোক। পাথর ছুড়ে মারার ঘটনাগুলো শতবারের বেশি গণমাধ্যমের খবর হলেও পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি হয়নি। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। রেলওয়ে আইনে ১২৭ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৩০২ ধারা অনুযায়ী পাথর নিক্ষেপে কারও মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। আসুন আমরা সচেতন হই। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপকারীদের ধরিয়ে দিন। রেলমন্ত্রী এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করতে একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিন।
- রশীদ এনাম লেখক ও প্রাবন্ধিক