আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিনবার। কিন্তু এর মেয়াদকাল ছিল ১৮ মাস। আরও একবার বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। প্রকল্প শুরু থেকে এ পর্যন্ত কেটে গেছে ৪৩ মাস। তবুও সম্পন্ন হচ্ছে না দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই প্রকল্পের কাজ। সাড়ে ১০ কিলোমিটার রেলপথের ভারতের আগরতলা অংশে পড়েছে ৪ কিলোমিটার, বাকিটা বাংলাদেশ অংশে। ভারতের অংশের কাজ প্রায় শেষ হলেও বাংলাদেশ অংশে অগ্রগতির ধীরগতিতে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে ভারতীয় ঋণে। বাস্তবায়ন করছে ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। বর্তমানে প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের ভৌত অগ্রগতি ৫২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সবশেষ বেঁধে দেওয়া সময়ের (২০২২ সালের জুন) মধ্যেও শেষ হচ্ছে না প্রকল্পের কাজ। ফলে মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না জানিয়ে যথাসময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না করলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে প্রকল্পটির ওপর অনুষ্ঠিত প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা হয়। সভায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় আরও কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে অন্যতম প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা পরিহার করতে ব্যয় ও মেয়াদ এক বছর বাড়ানো। চুক্তির মেয়াদে ঠিকাদার প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে চুক্তির সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ এবং নিয়ম অনুযায়ী ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, ‘কোভিডসহ নানা কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আরও একবছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এটা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সুপারিশ করলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ মতামত দেবে। এরপর পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াবে। ঠিকাদার ও কোভিড-১৯ এর কারণে মূলত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে।’
প্রকল্পের পরিচালক মো. আবু জাফর মিয়া বলেন, ‘ভারতের অংশের রেললাইনের কাজ হয়ে গেছে। এটা আমি দেখেছি।’
যাতায়াতে সুবিধা ছাড়াও ব্যবসায়িক সুবিধা বাড়বে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘একটা আলাদা রুট তৈরি হবে। এতে শুধু যাত্রী নয়, পণ্যও সরবরাহ করা যাবে। তবে কী কী পণ্য আমদানি-রপ্তানি হবে সেটা উভয় দেশ সিদ্ধান্ত নেবে অন্যান্য রুটের মতো।’
প্রকল্পটি জুন ২০২২-এ শেষ করার জন্য পরিকল্পনা কমিশন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, আইএমইডি ও বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হলেও ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে না বলেই জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা ও ধীরগতির কারণ
প্রকল্পটি ভারতীয় অনুদানে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও ভারতীয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব মালামাল অনুদানের শর্তানুযায়ী ভারত থেকে আনতে হয়। করোনার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতে লকডাউন জারি থাকায় প্রকল্পের সাইটের কাজ বন্ধ ছিল। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে প্রকল্পের কাজ চলমান।
প্রধান প্রধান কার্যক্রমভিত্তিক বাস্তবায়ন অগ্রগতি
এমব্যাংকমেন্টের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৫ শতাংশ। ১৫টি সেতুর মধ্যে ১২টির নির্মাণকাজ সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় রেল ক্রয় ও সাইট আপ সম্পন্ন, আংশিক ব্যালাস্ট সাইট আপ করা হয়েছে, পি-ওয়ে ফিটিংস সংগ্রহ ও সাইট আপ করা প্রক্রিয়াধীন। শিগগির ট্যাক লিংকিং কাজ শুরু হবে।
বারবার প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ব) মো. সুবক্তগীন এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। বদলিজনিত কারণে বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ব) হিসেবে মো. আবু জাফর মিঞাকে পদায়ন করা হয়েছে। এখনো তাকে আলোচ্য প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে প্রকল্পের কাজকর্মে অসুবিধা হচ্ছে। বারবার প্রকল্পের পরিচালক পরিবর্তনে ব্যাঘাত ঘটছে কাজের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলওয়ে লিংক (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পের সাবেক পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘নানা কারণে প্রকল্পের কাজ সঠিক সময়ে হয়নি। এর মধ্যে অন্যতম কোভিড-১৯। প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রী ভারতের। কোভিডের কারণে বাংলাদেশে আসতে পারেনি। এছাড়া পরামর্শকরাও ভারতের। কোভিডের কারণে তারাও সাইটে আসতে পারেননি। করোনা সংকটে ভারতের স্লিপার তৈরির কারখানাও বন্ধ ছিল। স্লিপারও সঠিক সময়ে দেশে আসেনি।’
জানা যায়, টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। রেলপথ নির্মাণে প্রধান সমস্যা প্রকল্প এলাকায় কাজ করার পর বিল পেতে ছয় মাস দেরি হয়। কারণ উভয় দেশের প্রসেসিং সম্পন্ন হওয়ার পর বিল পান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ফলে অনেক কাজের বকেয়া রয়ে গেছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাকি তিন মাস। এই সময়ে বিল জমা দিলে আরও ছয় মাস সময় লাগবে। তাই বিল জমা না দিয়ে নিজেদের কোম্পানির টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ হলে সরকারের কাছ থেকে বিল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিটি। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ ও করোনা সংকটের কারণে প্রকল্পের কাজে ধীরগতি হয়েছে দাবি কর্তৃপক্ষের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) ও আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলওয়ে লিংক (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ভাস্কর বকশি বলেন, ‘করোনা সংকট কাটিয়ে কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। ভারত থেকে স্লিপারও এসেছে। আশা করি আমাদের টার্গেটে পৌঁছাতে পারবো।’
প্রকল্পের কাজে ধীরগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভূমি অধিগ্রহণের কারণে কাজের ধীরগতি হয়েছে। ফসলের জমি কেউই ছাড়তে চায় না। এছাড়া জমিতে অনেক স্থাপনা, ঘরবাড়ি ছিল। এগুলো অপসারণ করতে সময় লেগেছে। এরপর যেটা অন্যতম কারণ সেটা হলো করোনার থাবা। শুধু আমি ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশে ছিল না। প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট সবাই ভারতে চলে গেছে। করোনার কারণে কেউ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি। সীমান্তে নানা জটিলতা ছিল করোনার কারণে। তবে সব সংকট কাটিয়ে প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে।’
এ বিষয়ে আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলওয়ে লিংক (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া না হওয়ার বিষয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। তবে উভয় দেশের চাপ আছে প্রকল্পটি সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের জন্য। আমরা চাই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। দুই দেশের মানুষ সুফল ভোগ করুক।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের দৈর্ঘ্য সাড়ে ১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে চার কিলোমিটার অংশ ভারত ও বাকি অংশ বাংলাদেশে। রেলপথটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর সীমান্ত পর্যন্ত যাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দুই দেশের মানুষ সহজে স্বল্প খরচে যাতায়াত করতে পারবেন।
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ২১ মে ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। ১৮ মাস মেয়াদি এ প্রকল্প কাজের ব্যয় ধরা হয় ২৪০ কোটি ৯০ লাখ ৬৩ হাজার ৫০১ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই প্রকল্পের কাজ শুরু করে। কাজ ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে। এর পরে বর্ষা মৌসুমের কারণে কাজ করতে না পারায় সময় বাড়ানোর আবেদন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে প্রথম দফায় বর্ধিত সময়ের মধ্যে মহামারি করোনাভাইরাস হানা দেওয়ায় কাজ বন্ধ ছিল। ফলে প্রথম দফায় বাড়ানো সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি।
সার্বিক দিক বিবেচনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। নতুন করে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই মেয়াদেও হচ্ছে না প্রকল্পের কাজ। নতুন করে ২০২৩ সালের জুন নাগাদ মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।