খুলনা-মোংলা রেলপথের যে পাঁচটি সেতু দেবে গিয়েছিল, সেগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঠিক করা হয়েছে। এখনো বাকি থাকা প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জায়গায় চলছে রেললাইন বসানোর কাজ। বাকি রয়েছে ফিনিশিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের মতো কাজ। হাতে সময় বেশি না থাকায় দিন-রাতে সমানতালে এসব কাজ চলছে। আগামী ৯ নভেম্বর রেলপথটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১০ সালে খুলনার ফুলতলা রেলস্টেশন থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পটি তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও ১০ বছর। মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে প্রকল্পের ব্যয়ও। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা থাকলেও কয়েক দফায় মেয়াদ বেড়ে বর্তমানে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকার বেশি। ভারত সরকারের ঋণসহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো ও ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জমি অধিগ্রহণে দেরি হওয়া, যথাসময়ে মালামাল সরবরাহ না হওয়া, রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণে দেরি হওয়া, জলপাইগুড়ি থেকে আনা রেললাইনের স্লিপার বাতিল হওয়া, করোনাসহ নানা কারণে প্রকল্পটি শেষ হতে এত সময় নিয়েছে।
১৮ অক্টোবর মোস্তর মোড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রেলপথ স্থাপনের জন্য তৈরি রাস্তার প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে কোনো রেললাইন বসানো হয়নি। উত্তর দিকে লাইন বিলপাবলা গ্রামের কাঁচনাপাড়া এলাকার রেলপথের জন্য তৈরি মাটির রাস্তার ওপর পাথর ফেলা হচ্ছে। সেখান থেকে আরও আধা কিলোমিটারের মতো উত্তর দিকে গিয়ে দেখা যায়, পাথরের ওপর রেলের স্লিপার ফেলে রাখা হয়েছে। রাতে কাজ করার জন্য হ্যালোজেন লাইট স্থাপনের কাজ করছেন কয়েকজন।
কাঁচনাপাড়া এলাকায় খালের ওপর একটি ছোট সেতু তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, ওই রেলসেতুটির দুই পাশের দুটি পিলার দেবে গিয়েছিল। পরে পিলারের ওপর বসানো লোহার গার্ডার তুলে কংক্রিটের ঢালাই করে উচ্চতা ঠিক করা হয়েছে। এ ছাড়া পিলার যেন আর দেবে না যায়, এ কারণে খালের মধ্যে বসানো পিলারের গোড়ার অংশে বেশ মোটা কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হয়েছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে মোহাম্মদ নগর স্টেশন গিয়ে দেখা যায়, স্টেশন ভবনের উত্তর পাশের দেয়ালে বড় অংশজুড়েই ফাটল ধরা অবস্থা দেখা গেছে।
ওই কাজের সঙ্গে যুক্ত রেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলপথটি গেছে ডুমুরিয়ার ডাকাতিয়া বিলের মধ্য দিয়ে। ওই বিলের মাটি বেশ নরম। এ কারণে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর পাঁচটি সেতুর পিলার দেবে গিয়েছিল। তবে প্রকৌশল জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ার তা সংস্কার করা হয়েছে। এ কারণে ওই এলাকায় রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ করতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করে ৩১ অক্টোবর পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।
খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, রেলের ফিটিংস, স্টেশনের সিগন্যালিং, টেলিকমিউনিকেশনের যন্ত্রপাতি রাখা আছে। উদ্বোধনের আগেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। যেখানে রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে, সেটিও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে।
উদ্বোধনের কয়েক দিন আগেও রেললাইন বসানোর কাজ শেষ না হওয়ার বিষয়ে আরিফুল ইসলাম বলেন, রেলপথের মোস্তর মোড় থেকে লতা সেতু পর্যন্ত মাটি নরম। এ কারণে পাঁচটি সেতুর বেজমেন্ট দেবে গিয়েছিল। সেটি সংস্কার করা হয়েছে। এ কারণে ওই এলাকার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রেলপথ আগে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন দ্রুতগতিতে কাজ চলছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই রেলপথ পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে।
স্টেশন ভবনের সমস্যার বিষয়ে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ আছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যদি কোনো ভবন বা স্টেশনে সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা তা ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেব না। যে সমস্যা আছে তা সংস্কারযোগ্য, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা সংস্কার করে দেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।’
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রকল্পের আওতায় রূপসা নদীর ওপর ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটারের রেলসেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। প্রায় ৮৮ কিলোমিটার রেললাইন বসানো শেষ হয়েছে। রেলপথটির ৯টি প্ল্যাটফর্মের সব কটির পাশাপাশি ১০৭টি ছোট সেতু ও ৯টি আন্ডারপাস নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে। ফুলতলা-মোংলা পর্যন্ত রেলপথ চালু হলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হবে এবং মোংলা বন্দর ব্যবহার করে কম খরচে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির সুযোগ ঘটবে।
নির্মাণকাজ দেখতে ১৪ অক্টোবর খুলনায় ও মোংলা আসেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। রেলপথ উদ্বোধনে একটু সময় লাগলেও কাজের মান দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, রেলপথের দু-তিনটি ব্রিজে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল, ইতিমধ্যে সেগুলো ত্রুটিমুক্ত করা হয়েছে। পুরো রেলপথ ত্রুটিমুক্ত করেই উদ্বোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।